স্কুলে পিয়ালির সাথে আজ ঝগড়াই হয়ে গেল। গত বুধবার ওর জন্মদিনে আমি প্রথমবার ওদের বাড়ি গেছিলাম । এবারে আমাদের সবার থার্টিন ইয়ার্‌স্‌ হচ্ছে। আমরা এখন আর কিড্‌স নই, টিন্‌স। তাই পিয়ালির স্পেশ্যাল জন্মদিনে আমাদের কয়েকজন ক্লাস ফ্রেন্ডকে বাড়িতে পার্টিতে ডেকেছিল।

ওদের বাড়িটা পুরনো। বিবেকানন্দ রোডে। দেখলে মনে হয় গল্পে পড়া জমিদার-বাড়ি; অনেক জায়গা ভেঙে-টেঙ্গে গেছে। একদিকে সারে সারে তালা মারা সব ঘর। সেগুলো নাকি শরিকদের। শরিক মানে কি, সেটা পিয়ালি ঠিক বলতে পারল না। মা’কে জিজ্ঞেস করতে হবে। তা সেই বাড়ি দেখে তো আমি, অর্ণা, ফিরোজা, কমলিনী, অস্মিতা, টিনা- সবাই হাঁ। আমাদের সবারই বাড়ি ওদের বাড়ির থেকে একদম আলাদা। ব্যাস, আর কি ! পিয়ালিটা এমনিতেই এক নম্বরের গুলবাজ। তার মধ্যে অস্মিতা যেই বলেছে, ওদের বাড়িটা নাকি ‘হন্টেড হাউস’-এর মত দেখতে, অমনি সেই থেকে রোজ টিফিন টাইমে আর গেমস্‌ পিরিয়ডে পিয়ালি খালি গল্প ফেঁদে যাচ্ছে। রোজ রাতে নাকি ওদের বাড়ির টানা বারান্দায় কারা সব হেঁটে বেড়ায়, ফিসফিস করে কথা বলে। সব ডাহা মিথ্যে কথা। এক আমি বাদে গ্রুপের বাকি সবাই ওর কথা হাঁ করে গিলছে। অস্মিতাটা তো আরো বড় ন্যাকা, সেইসব গল্প শুনে এত্ত বেশি “ওরে বাবারে- আর বলিস না রে” করছে, দেখে শুনে গা-পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। দুই-তিন দিন ধরে হজম করার পরে আজকে শেষমেষ টিফিন টাইমে বলেই দিলাম- “বানিয়ে বানিয়ে এসব গল্প করার কোন মানে হয় না, ভূত-টুত বলে আসলে কিছুই নেই, সব ভীতু মানুষদের কল্পনা”। ব্যাস, লেগে গেল ঝগড়া। পিয়ালিটা প্যাঁচার মত মুখ করে বসে রইল, বাকি সময়টা আর কথা বলল না, আর অস্মিতা ছুটির পরে চোখ গোল গোল করে আমাকে ফিস ফিস করে বলে গেল- “ প্রত্যুষা, আজ কিন্তু শনিবার”। হুঁ, শনিবার তো কি??

আমি ভূতে ভয় পাই না; ভূত বলে যে আসলে কিছু নেই, সেটা মা আমাকে বলে দিয়েছেন। মায়ের কথা কেউ অবিশ্বাস করে? একদম ছোট্টবেলায়, সাবিত্রীপিসি যখন আমাকে খাবার খাওয়ানোর জন্য ভূতের ভয় দেখানোর চেষ্টা করত, তখনই মা তাকে খুব বকে দিয়েছিলেন। তারপরেও যেটুকুও বা ভয় পেতে পারতাম, গত কয়েক বছর বইমেলা থেকে লীলা মজুমদারের ‘সব ভূতুড়ে’ আর শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘কিশোর সমগ্র’ কিনে এনে পড়ার পর থেকে আর আমার ভূত নিয়ে এক ফোঁটাও ভয় নেই। আমি বুঝে গেছি, ভূতেরা আসলে খুব ভাল, অকারণে মোটেও কারোর ক্ষতি করে না। এমন কি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ - সেখানেও দেখ, ভূতের রাজা কত ভাল। দেখে ভয়ই করে না। গুপী-বাঘার মত আমার সাথে দেখা হলে বরং ভালই হত। একটা কিন্ডল চেয়ে নিতাম। টিভিতে ‘হরর শো’ তে যে সব গল্প দেখায়, সেগুলো সব বিশ্রি গল্প। মা আমাকে ওইগুলো কোনটাই দেখতে দেন না। আমি দেখতে চাইও না। অস্মিতাটা একটা গাধা। রাতের বেলা আজগুবি ভয়ের সিরিয়াল দেখবে, আর সকালে পিয়ালির বানানো গল্পে  ‘ওরে বাবা ওরে বাবা’ করবে।

এত রাগ হচ্ছে, কি বলব আর! মাথাটা ঠাণ্ডা করা দরকার, নাহলে আজকে আর পড়ায় মন বসবে না। মা থাকলে সব কথা বলা যেত, কিন্তু মায়ের আজকে অফিস থেকে আসতে দেরি হবে। হুঁ, চাইলে ওরকম গল্প আমিও বানাতে পারি। আমাদের এই বাড়িটাই কি কম পুরনো নাকি। ওদের মত অত বড় হয়ত নয়, কিন্তু অনেক পুরনো। আমার দাদুর বাবা বানিয়েছিলেন এই বাড়িটা। আমাদের এই একতলা বাড়িটার পেছন দিকে বাইরে দিয়ে ছাদে ওঠার জন্য একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ি আছে। সেটা মাঝে মাঝে এক একটা ধাপ আধভাঙা হয়ে গেছে মরচে পড়ে, আর একটু নড়বড় করে, তাই বাড়িতে মা না থাকলে ওঠা বারণ। কিন্তু আমি চুপি চুপি মাঝেমধ্যেই উঠে যাই। দুপুরবেলা বা সন্ধেবেলা। সাবিত্রীপিসি তখন ঘুমায় বা সিরিয়াল দেখে, টের পায় না। আমাদের বাড়ির লাগোয়া রেলস্টেশন। ছাদে উঠলে স্টেশনটা দেখা যায়। তিনটে প্ল্যাটফর্ম। কত কত লোক। হুশ হুশ করে লোকাল ট্রেন আসছে আর যাচ্ছে। ঘন ঘন অ্যানাউন্সমেন্ট হচ্ছে। চুপচাপ বসে বসে দেখতে আমার খুব ভাল লাগে। আমি ছাদে যাব। এখনি। সাবিত্রীপিসি খাবার ঘরে সিরিয়াল দেখছে। টের ও পাবে না।

ছাদে উঠে মনটা বেশ ভাল হয়ে গেল। ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে। গোল একখানা বড় সাদা চাঁদ উঠেছে। আজকে তার মানে ফুল মুন। ফুল মুনে তো আবার ওয়ারউল্‌ফ্‌রা মানুষ থেকে নেকড়ে হয়ে যায়... হিহি...অস্মিতাটা এখন থাকলে ওকে ওয়ারউল্‌ফ-এর ভয় দেখানো যেত...ধুস...ছাদটা যদিও ধুলোয় ভরা, আমি তাও শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে চাঁদ, আর আকাশ দেখতে বেশ ভাল লাগছে। গুন গুন করে গাইতে লাগলাম

“ভূতের রাজা দিল বর

জবর জবর তিন বর...এক দুই তিন...

একখানা কিন্ডল যদি পাই...এক নম্বর , এক নম্বর...”

দুই আর তিন নম্বরে কি কি চাওয়া যেতে পারে ভাবছি, এমন সময়ে কে যেন জিজ্ঞেস করল- “তুমি বুঝি খুব গল্পের বই পড়তে ভালবাস?”

কে রে ? তড়াক করে উঠে পড়লাম। ছাদে তো কেউ নেই। কোন চোর বা বাজে লোক নাকি? রেল লাইনের দিক থেকে পাঁচিল টপকে চলে এসেছে?

“এই যে, এদিকে , এদিকে- শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি আমাদের বাড়ির পেছনে যে বাড়িটা, যাদের দেওয়াল আমাদের ছাদের পাঁচিলের সাথে মিশে আছে, সেখানে জানলায় দাঁড়িয়ে একজন লোক। ওই বাড়ির দোতলায় কেউ থাকে বলে তো জানতাম না। ওই জানলাটাতো মনে হয় বন্ধই থাকে। নতুন ভাড়াটে?”

“বলছি যে, তুমি কি গল্পের বই পড়তে খুব ভালবাস?”

“হ্যাঁ। খুব ভালবাসি।“

“একটা কিন্ডল থাকলে সুবিধা হয়, তাই না?”

“হ্যাঁ, কিন্ডলে তো অনেক বই একসাথে রাখা যায়। সব জায়গায় নিয়েও যাওয়া যায়, আর ইচ্ছেমত পড়াও যায়...আপনি কে? আপনাকে তো আগে দেখিনি...মানে...”

“আমি ভূতের রাজা ! তুমি গান গাইছিলে তো, তাই শুনে খুশি হয়ে চলে এলাম।“

“ধ্যাত। আপনি দীপুদের বাড়িতে নতুন ভাড়া এসেছেন, তাই না?”

“তুমি বিশ্বাস করলে না তো, যে আমি ভূতের রাজা?”

“মোটেও না, আমি হেসে বললাম, ভূত –ফুত বলে কিছু হয় না।“

“এই তো দুঃখ...বেশিরভাগ লোক তোমারই মত, বিশ্বাসই করতে চায় না...যাকগে, তা বাকি বর দুটো কি কি চাই ?”

আমার খুব মজা লাগছিল লোকটার সাথে কথা বলতে। লোকটার ঘরে কোন আলো জ্বলছিল না, গলির আলো ছাদ অবধি আসে না,তাই মুখটা পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু গলার স্বরটা বেজায় ভাল, অনেকটা অমিতাভ বচ্চনের মত। আর গায়ে সাদা শার্ট, সেটা দেখতে পাচ্ছিলাম।

“সেকন্ড আর থার্ড বর নিয়ে এখনো ভাবিনি...আমার উইশ–লিস্ট খুব লম্বা।“

“আচ্ছা, তাহলে ওই প্রথম বরটাই তোমাকে গ্রান্ট করলাম, বুঝলে। বাকি দুটো নাহয় পরে কোনওদিন  দেব... মা এসে গেছেন, এবার নিচে যাও...”

বলতে বলতেই নীচ থেকে মায়ের গলার আওয়াজ পেলাম- “রিনি-ই...রিনি-ই...”-এইরে, মা বুঝে গেছেন আমি এই সময়ে ছাদে এসেছি, যা বকা লাগাবেন না !...এখন তাড়াতাড়ি নিচে নেমে মায়ের বকুনির থেকে বাঁচতে হবে...কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না, অথচ ওই লোকটা জানল কি করে মা এসে গেছে ? ...সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললাম- “আমি এখন যাচ্ছি, আবার কাল কথা বলব...মা খুব বকবেন...”বলতে বলতে সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকলাম।

নিচে এসে দেখি সাবিত্রী পিসি রান্নাঘরে কাঁচুমাচু মুখ করে বাজারের ব্যাগ থেকে ফল , সব্জী এইসব বার করছে, আর মা গম্ভীর মুখে সোফায় বসে, হাতে ঠাণ্ডা জলের গ্লাস। বুঝলাম বেচারি সাবিত্রীপিসি খুব বকুনি খেয়েছে। ঘড়িতে দেখি রাত সাড়ে ন’টা। আমাকে দেখে মা খুব শান্ত গলায় বললেন-

“তুমি সাবিত্রীপিসিকে না বলে সন্ধেবেলা একা ছাদে গিয়ে ঠিক করনি রিনি...এখন বড় হচ্ছ, সব কাজ করার আগে ভেবেচিন্তে করতে হয়...তুমি জান আমাদের বাড়িগুলোতে রেল লাইনের দিক থেকে কত সহজেই পাঁচিল টপকে চলে আসা যায়,  চারিদিকে বাজে লোকের এত উৎপাত, আর তুমি প্যাসেজের তালা খুলে ওকে কিছু না বলে ছাদে চলে গেলে?”

বুঝলাম মা খুব খুব রেগে আছেন। আমি জানি এই সময়ে কি করতে হয়। মায়ের পাশে গিয়ে মাকে খুব করে জড়িয়ে ধরে বললাম- “ও মা, মা, আমি স্যরি মা...কি করব বল...স্কুলে পিয়ালির সাথে ঝগড়া হয়েছে...খুব রাগ হয়েছিল, পড়তে ইচ্ছা করছিল না, তাই ছাদে চলে গেছিলাম...ও মা...বলছি তো স্যরি...”

যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই হল। একটু পরে মা ফিক করে হেসে ফেলে বললেন- “তিন দিন আগে জন্মদিনে খেয়ে এলি, আর আজ ঝগড়া হয়ে গেল? কেন?”

ব্যাস, মায়ের প্রশ্ন শোনা মাত্র গড়গড় করে সব বলে দিলাম। উফঃ বাবা, এবার শান্তি। এত কথা পেটে চেপে রাখা যায় ! তবে দীপুদের বাড়ির লোকটার কথা বাদ দিয়ে দিলাম। অচেনা লোকের সাথে ছাদে দাঁড়িয়ে গল্প করেছি শুনলে মা  আবার সত্যি সত্যি খুব রেগে যাবেন।

সব শুনে-টুনে মা বললেন- “আচ্ছা, তাহলে তো দেখছি তোর রাগ কমানোর একটা ব্যবস্থা করতেই হয়...” এই বলে নিজের অফিস ব্যাগ থেকে একটা গিফ্‌ট প্যাকেট বার করে আনলেন।

“এটা আনতে গিয়েই তো আজ দেরি হল...দেখ, তোর জন্য একটা জিনিষ আছে, পছন্দ হয় কিনা,”

“গিফট? আমার জন্য? ওহ মা, তুমি কি ভাল, কিন্তু আমার তো এখন বার্থ ডে নয়, দুই মাস দেরি আছে...”বলতে বলতে র‍্যাপিং পেপার খুলেই আমি হাঁ ! বাক্সটা একটা কিন্ডলের ! একদম নতুন মডেল, সোয়াইপ স্ক্রিন, রঙিন।

“হ্যাঁ, তোর জন্মদিন দুই মাস পরে ঠিকই, ধরে নে গিফট্‌টা আগে এসে গেল...মনে মনে তো এটা চাইছিলি, তাই না?...কিরে, ওরকম হাঁ হয়ে গেলি কেন? মডেলটা পছন্দ হয়েছে? অনেকদিন ধরেই প্ল্যান করছিলাম রে সোনা, তোকে একটা কিনে দেব...তোকে সারপ্রাইজ দেব বলে ডেলিভারির জন্য এ বাড়ির না দিয়ে সোনামাসির বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিলাম...”

মায়ের সব কথা আমার কানে ভাল করে ঢুকছিল না। দীপুদের জানলায় লোকটা কে? সত্যি ভূতের রাজা? লোকটা তো বলল প্রথম বর তোমাকে গ্রান্ট করলাম... আর মা কিন্ডল নিয়ে হাজির... বুকের মধ্যে ধুকপুকানিটা হঠাৎ করে খুব বেড়ে গেল। বুঝতে পারলাম গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে যাচ্ছে, পিঠ বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত সরসর করে নেমে যাচ্ছে।

যাহঃ তাই হয় নাকি? এটা নেহাৎই কাকতালীয়, আর কিছু নয়। কিন্তু...

নাহঃ কালকে সন্ধেবেলা মা’কে লুকিয়ে আবার আরেকবার ছাদে উঠতে হবে।