একটা সিরিজ লিখব ঠিক করলাম। ঠিক করলাম বলা ভুল, আসল কথা হল, ভাবছি অনেকদিন থেকে। অনেক কিছুই লিখতে ইচ্ছে করে, লিখে রাখতে ইচ্ছে করে। যত দিন যাচ্ছে, দেখছি পুরনো সব কথা ভুলে ভুলে যাচ্ছি,। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ বয়স বাড়ছে, মাথায় প্রসেস করার এবং জমিয়ে রাখার মত তথ্য ক্রমশঃ বাড়ছে। কিন্তু কত কথাই তো আছে, যা ভুলতে চাই না - কত মানুষ, কত ঘটনা, কত জিনিষ। নিজের জন্যই সেসব বিষয়ে লিখে রাখা দরকার। আর তা ছাড়া, মাঝে মাঝে ফেসবুকে পোস্ট করার মত বিষয় ও তো চাই নাকি ?

ভেবেচিন্তে ঠিক করেছি, এই সিরিজের নাম হল ‘বাসী খিচুড়ি’ । আমাদের বাড়িতে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর ভোগে তৈরি হওয়া খিচুড়ি প্রসাদ প্রতি বছরেই অবশ্যম্ভাবী ভাবে বেশি তৈরি হত। পরের দিন সকালে সেই বাসী খিচুড়ি এবং ভাজা, লাবড়া ইত্যাদি দিয়ে জলখাবার খাওয়া হত। আমার রাঙাকাকু বলেন, বাসী খিচুড়ির স্বাদ নাকি টাটকা খিচুড়ির থেকে অনেক বেশি ভাল। লক্ষ্মীপুজোর পরেরদিন সকাল বেলায়, এমন কী মাঝে মাঝে সকাল পেরিয়ে দুপুরেও খিচুড়ি খাওয়ার সময়ে রাঙাকাকুর আহা, উহু করে চেটেপুটে খাওয়া দেখে এই ‘অনেক বেশি ভাল’ ব্যাপারটা মেনেও নিয়েছিলাম- মানে , আমি নিজে সেরকম তফাৎ না বুঝলেও, আসলে নিশ্চয় বেশি ভাল- সেটা মেনে নিয়েছিলাম। হয়ত আসলে খিচুড়িটা বা সেটা বাসী হয়ে যাওয়াটা নয়, আসল স্বাদবদলটা হত ওই ধর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমে সারা পরিবারের একত্র হয়ে হই-হই করার মধ্যে দিয়ে। আমার এই সিরিজের নাম বাসী খিচুড়ি রাখার মূল কারণ হল, আমি এটাতে লিখব যতসব পুরনো কথা, আগের কথা, অতীতের কথা, বাসী হয়ে যাওয়া কথা। আর খিচুড়ি যে হবেই, সেটা তো বলাই বাহুল্য। ভেবে দেখেছি, আমার ফেসবুকের পোস্টগুলিরও হ্যাশট্যাগ হওয়া উচিত বাসী খিচুড়ি, কারণ আমি দিনের ঘটনা দিনে পোস্ট করা প্রায় ভুলেই গেছি। কিছু নিয়ে লিখতে ইচ্ছে হলেও, সেটাকে একদিনের নামে বহুদিনের বাসী হওয়ার পরে হয়ত লিখি, বা লিখিই না। আমার এই নতুন সিরিজের নাম ‘বাসী খিচুড়ি’ রাখার অন্য আরেকটা কারণ ও আছে। মাঝেমধ্যে বাসী ( শুধু বাসী কেন, টাটকা হলেও) খিচুড়ি খেয়ে লোকজনের ভয়ানক পেট খারাপ হয়। আমার এই বাসী খিচুড়ি পড়ে , হতেও পারে, কারোর কখনও পেট, থুড়ি, মন খারাপ হল, কিংবা পোষাল না। সেক্ষেত্রে যোয়ানের আরক ( মতান্তরে ডার্ক চকোলেট) , এবং তারপরে ডাক্তারের কাছে যাওয়াই বিধেয়। এই হাবিজাবি খিচুড়ি পড়ে শারিরীক বা মানসিক বিপর্যয় হলে কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।
-------------+++++-----------
চা

(১)

বিকেল সাড়ে চারটে বা পাঁচটা বাজে। কিংবা সাড়ে পাঁচটা। পশ্চিমের সবুজ খড়খড়ি আর চারকোনা মোটা শিকের জানলা দিয়ে এসে, লাল ফাটাফুটি মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে শেষ বিকেলের সূর্যের আলো। একটু নরম, একটু মনমরা। মেঝের এক কোণে, বাসন রাখার ছোট তাকের পাশে বসে সাদা, চেক চেক ছাপ, ফুল ছাপ বিভিন্ন রকমের কাপে চা ঢালছেন দিদু। কেটলি থেকেই মনে হয়, এখন আর মনে পড়ে না চা কেটলিতে তৈরি হত নাকি সসপ্যানে। সদ্য নেভানো জনতা স্টোভের কেরোসিন পোড়া ধোঁয়ার সাথে মিশে যাচ্ছে সদ্য ঢালা চায়ের আমেজ মেশানো ধোঁয়া। দিদুর সামনে গোল হয়ে বসে বাড়ির সদস্যেরা। দাদুকে ঘরে গিয়ে কেউ চা দিয়ে এসেছে। কাকুমণি, মা, বাবা, পিসিরা, যারা যারা সেই সময়ে বাড়িতে আছেন, তাঁরা পাশাপাশি গোল হয়ে, বাবু হয়ে বা হাঁটু মুড়ে বসেছেন। কৌটো থেকে হাতে হাতে চলে যাচ্ছে লেড়ো বিস্কুট। রাস্ক নয়, লেড়ো; ব্যাঁকাতেড়া চেহারা, একেকটার একেক ভঙ্গিমা; শক্ত, খটখটে। চায়ের কাপে লেড়ো ভিজিয়ে কামড়, সাথে একটু চুমুকের সাথে সাথে চলে নানা গল্প। সবার সাথে বসে, সাত, আট, নয় বছরের আমি। আমিও চা খাচ্ছি। লেড়ো দিয়ে। আর নিজেকে বেজায় বড় মনে হচ্ছে। সঙ্গে ভাই; কখনও কখনও আমার আরও ছোট্ট ছোট্ট পিসতুতো ভাইয়েরা- জোছন আর বুটুন। সবাই একটু হলেও চা খাচ্ছে। সঙ্গে লেড়ো বিস্কুট। এই ঘরোয়া টিপার্টিতে সবার গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল। দিদু চা দিচ্ছেন, তাই বাবা-মায়েরাও কিছু বলতেন না। মনে আছে, একবার দুর্গাপুজোর মেলা থেকে দিদু নতুন কাপ কিনে আনলেন। আমার আর ভাইয়েরটা বড়দের কাপের থেকে একটু ছোট। কিন্তু জোছন আর বুটুনের কাপগুলো একেবারেই খেলনা কাঁচের কাপ; আমাদের দুটো ওদের দুটোর থেকে একটু বড়। সেই কাপে করে চা খেয়ে যে নিজেদেরকে পরিবারের আরও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মনে হয়েছিল, সে বলাই বাহুল্য।
সবার চা খাওয়া হয়ে গেলে সব কাপ, ছাঁকনি, কেটলি সব জমা হত একটা ছোট্ট নীল গামলাতে। সেটা নাকি আমার জন্মের পরে কেনা হয়েছিল, আমাকে স্নান করানোর জন্য। সেইসব জমা বাসন ধোয়া হত রাত আটটার পরে কর্পোরেশনের জল এলে। সেটা আরেক গল্প।

আমার জীবনের.প্রথম সুখময় স্মৃতিগুলির সাথে জড়িয়ে আছে চন্দননগরের বাড়ি এই বৈকালিক চা বৈঠকের উষ্ণকোমল স্মৃতি।