(এই গদ্যটি আমার লেখার কথা নয়, দরকার ও ছিল না। একজন কিঞ্চিৎ দাবী জানালো বলে, ভাবলাম লিখি। এই গদ্যের শিরোনাম হতে পারে 'একটা শাড়ির গল্প', কিংবা 'কয়েকটা রঙের গল্প'; কিংবা 'কয়েকটা ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবনা'। নাহলেও ক্ষতি নেই। সব কিছুই যে নিয়ম মেনে হতে নেই, সে আর কে না জানে?)

দিন কয়েক আগে একটি শাড়ি চোখে পড়েছিল। একসঙ্গে গোটা কুড়ি হয়ত শাড়ি ছিল। তার মধ্যে একটা সবুজ চোখ টানল। সে এক বড় অদ্ভূত সবুজ। একটু ধীর স্থির, যেন একটু ভাবছে কিছু। সদ্য গজানো কচিপাতার মত ঝকঝকে, ফিনফিনে, উজ্জ্বল সবুজ নয়। সোঁদা গন্ধওয়ালা পুরনো ঘাসের মত আধা ফ্যাকাশে বা বুনো গন্ধে ভরা পুটুশ গাছের পাতার মত কালচে সবুজ নয়। এই সবুজটা আসলে থাকে বেশিরভাগ গাছের পাতার নিচের দিক গুলোতে, কিংবা বলা চলে পেছনের দিক গুলোতে।  একটু ম্লান, একটু ক্লান্ত, ওপরের পিঠের তুলনায় একটু চাকচিক্যের, জৌলুশের অভাব। দামাল বৃষ্টিতে নুইয়ে পড়া কচু পাতা , কিংবা সন্ধের মুখে ঘুমিয়ে পড়া শিরীষ পাতার পেছন পিঠ লক্ষ্য করলে এই রংটা হয়ত বোঝা যাবে। 

সেই জৌলুশহীন,অচঞ্চল সবুজ ভাবলে মায়ের পুরনো শাড়ির নরম আঁচলের কথা মনে পড়ে; বর্ষাকালের বৃষ্টিভেজা গাছপালাকে মনে পড়ে।  সবুজ রংটার কাছাকাছি একটা রঙ এবং নাম খুঁজছিলাম – অবশ্যই আমাদের সবজান্তা চিন্তামণি ইন্টারনেটে। খুঁজে পেলাম কাছাকাছি একটা রং। হয়ত আসলে সেটা কাছাকাছি নয়, একেবারেই আলাদা। কিন্তু আমার মনে হল কাছাকাছি। 'ওয়েব-সেফ' ২৫৬ টি রঙের মধ্যে একটি- মিডিয়াম সী গ্রিন। মানে গল্পে পড়া পান্না সবুজ সমুদ্র জলের একটি মাঝারি রকমফের। সেরকম সমুদ্র স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে আমি জানি, এ সবুজ সে সবুজ নয়। সদাব্যস্ত সমুদ্রের জল এই স্থিরতা ধরে রাখতে পারে না, পারবে না।  

সেই কবে স্কুলে উদ্ভিদবিদ্যা পড়েছিলাম, তখন নিশ্চয়ই জেনেছিলাম, কিন্তু কালস্রোতে আরোও অনেক কিছু মতই ভুলে গেছি, গাছের পাতার দুই পিঠের রং আলাদা কেন? তাই আবার একটু খুঁজতে লাগলাম চিন্তামণির ভান্ডারে। দেখলাম , তার ন্যায্য কারণ আছে। পাতার ওপরের দিক থাকে সূর্যের দিকে মুখ করে, তাই সেখানেই বেশি সালোকসংশ্লেষ হওয়ার সম্ভাবনা। তাই সেখানে ক্লোরোপ্লাস্টের ( যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অঙ্গ সালোকসংশ্লেষ করে ) পরিমাণ নিচের দিকে বা ছায়ার দিকে মুখ করে থাকা পিঠের থেকে অনেক বেশি। আবার সেই ওপরের ভাগকে বিবিধ প্রাকৃতিক আক্রমণ এবং বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য থাকে মোমের মত আস্তরণ। তাই সাধারণতঃ আমাদের চেনা পরিচিত স্থলজ গাছগুলির পাতাগুলির নিচের বা পেছনের দিক গুলো হয় খানিক অনুজ্জ্বল, খসখসে , একটু হালকা সবুজ রঙের, আর ওপরের দিক হয় উজ্জ্বল, চকচকে, গাঢ় সবুজ রঙের,। আহা! এপিঠ আর ওপিঠ – যেন ' তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও' বলা অনুগতা স্ত্রী আর  রোজগার করে আনেন বলে তেলে-জলে থাকার অধিকারী স্বামী; কিংবা মুখবুজে খেটে যাওয়া আদবকায়দাবিহীন ডেস্ক ক্লার্ক আর প্রচুর ক্লায়েন্ট ধরে সফল, ঝাঁ চকচকে ম্যানেজমেন্ট একজিকিউটিভ।

আমি  আদবকায়দাবিহীন, মূলতঃ মুখবুজে ডেস্কে বসে খেটে যাওয়া স্ত্রী জাতি, তাই হয়ত ঐ মোম-পালিশ-বিহীন কিন্তু প্রাণরসে সিক্ত সবুজে আমার চোখ টেনেছিল। তাই প্রবল উৎসাহে শাড়িটি তুলে  নিয়ে ভাঁজ খুলেই একটু থমকালাম। শাড়িটির জমিটি সবুজ নয়, সেটি ঢালা স্লেট রঙা; কিংবা বলা যেতে পারে গাঢ় ধূসর, কিংবা হঠাৎ  জমে ওঠা কালবৈশাখীর মেঘের মত তার রং।  তবে সেই জমাট গাঢ় নীলচে ধূসর রঙে ধ্বংসের দ্বিধা নেই, বরং শীতল জলধারার আশ্বাস আছে। আর সেই মায়াবী সবুজ, পাড় এবং আঁচলেই সীমাবদ্ধ। বলতে বাধা নেই, কিঞ্চিৎ হতাশ হয়েছিলাম। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছি, ওই দুই রঙের সঙ্গতে, শাড়িটা আসলে আর শাড়ি নেই, হয়ে উঠেছে আমার ছোট্টবেলায় আঁকার মাস্টারমশাইয়ের কাছে বসে জলরঙে আঁকতে শেখা একটা ল্যান্ডস্কেপের মত। তিনি একদিন একটা ছবি আঁকতে শিখিয়েছিলেন। একটা মেঠো পথ ধরে খালি গায়ে, খেটো ধুতি পরনে একজন মানুষ হেঁটে আসছে, তার হাতে একটা লাঠির আগায় বাঁধা একটা পোঁটলা। পেছনের  পুরোটা কালো আর প্রুশিয়ান ব্লু তে মেশানো এক আকাশ। ক্যানভাসের দিগন্তরেখায় ছোট ছোট কিছু গাছের ইঙ্গিত, যেগুলি আসলে অনেক দূরে বলে আকারে ক্ষুদ্র, কিন্তু কাছাকাছি কোনো বাড়িঘর, বা বলা ভালো, মনুষ্যবসতির চিহ্ন নেই। একেবারে সামনে, বাঁদিকে কয়েকটা বড় বড় পাতাওয়ালা নাম না জানা গুল্ম – হলুদ আর সবুজের বিবিধ উজ্জ্বল মাত্রায় সেইসব বিভিন্ন আকৃতির পাতাগুলিকে রং করা হয়েছিল। পুরো ছবিটা শেষ হওয়ার পরে দেখতে বড়ই ভালো লাগছিল, কিন্তু আমার বালিকা মনে দুটো প্রশ্ন জেগেছিল – এক, এইরকম আবহাওয়ায় কেউ ছাতা ছাড়া বেরোয় নাকি? আর দুই, আকাশ ওইরকম কালো হলে কখনোও গাছের পাতা ওইরকম চকচকে, উজ্জ্বল দেখাতে পারে নাকি? আকাশ কালো হলে তো পুরো প্রকৃতিই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে। সে সময়ে এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দেয়নি, কারণ প্রশ্নগুলো আমি কাউকে করিনি। কিন্তু আরোও একটু বড় হয়ে, দুটো প্রশ্নেরই উত্তর আমি নিজেই খুঁজে পেয়েছিলাম। কৈশোরের রোমান্টিকতায় সেই ছবির পথিক আমার কাছে হয়ে উঠেছিল অপু-দুর্গার বাবা , গরিব পুরোহিত হরিহর রায়। আমি কল্পনা করতে ভালোবাসতাম, ওই পুঁটুলির মধ্যে করে সে বেঁধে নিয়ে চলেছিল তার সন্তানদের জন্য ছোট্ট ছোট্ট উপহার – আলতা পাতা (এই অদেখা , অজানা বস্তুটির প্রতি আমার অদম্য আগ্রহ ছিল), বাঁশি বা প্রনামীর মোয়া-মুড়কি। বৃষ্টি নামার আগেই সে পৌঁছে যেতে চায় নিশ্চিন্দিপুরে।আর গাঢ় ধূসর আকাশের পটভূমিতে যে  গাছপালার সবুজ-হলুদ, বিশেষ করে একবার বৃষ্টিধোয়া হলে, বড়ই উজ্জ্বল, বড়ই ঝলমলে লাগে দেখতে, সেটাও দৃষ্টিগোচর হয়েছে একটা বয়সের পর। প্রকৃতিকে চেনা, তার প্রতিটি মূহুর্তের পরিবর্তনকে পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করতে পারাটাও একটা অভ্যাসের ব্যাপার- কার্সিভ রাইটিং কিংবা নামতা মুখস্থ করার মত। সেটা কোনো একদিন হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে হয় না, রোজ অভ্যাস করতে হয়, রোজ অভিজ্ঞতা নিতে হয়। কবে কোন ঘরের নামতাটা মুখস্থ হবে, বা কোন অক্ষরটা নির্ভুল টানে লেখা যাবে, সেটা আগে থেকে স্থির করা যায়না। চেতনার শেষ ধারাটি যতক্ষণ বহমান, এই পাঠাভ্যাস ততদিন বহমান থাকবে। 

এমন নয় যে সব ধরনের পরিধেয় দেখেই আমার মনে এমন নানা চিত্রকল্প ফুটে ওঠে। সেটা হয়ত স্বাভাবিক ও নয়। কিন্তু যখন একটি পরিধানযোগ্য কাপড় , এখানে একটি শাড়ি,  এমন বহুস্তরীয় চেতনা প্রবাহের উৎস হয়ে ওঠে, তখন সেটি আর শুধুই একটা বারো-হাতি শাড়ি থাকে না, সেটি নিজেই একটা কাহিনি হয়ে ওঠে। 

(ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তে লেখা )