সারাদিন ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি হলে, কাজকম্মে মন বসে না, নানা পুরোনো হাবিজাবি কথা মনে পড়ে। এই যেমন আজ দুপুরে হঠাৎ মনে পড়ল, জীবনে প্রথম খুব মন দিয়ে দেখা হিন্দি আর ইংরেজি সিনেমার কথা।
আমার বাবা-মায়ের খুব হলে গিয়ে সিনেমা দেখার অভ্যাস ছিল না। তবে আমি আর ভাই যখন খুবই ছোট, তখন আমাদের নিয়ে গুগাবাবা আর সবুজ দ্বীপের রাজা দেখতে গেছিলেন, কিন্তু সেসবের খুব কিছু আমার মনে নেই বা ছিল না। তখন বাড়িতে টিভিও ছিল না। চন্দননগর গেলে তবেই টিভি দেখা যেত, তাও শনিবার বিকেলে সিনেমা শুরু হলে বাড়ির বড়োরা যাও যাও করে সেখান থেকে আমাদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিতেন। রবিবারের হিন্দি সিনেমা তো চলতই না। মোটকথা, ' হিন্দি বই' তো দূর অস্ত, 'বাংলা বই' দেখার ও পারমিশন সবসময়ে মিলত না এবং মেলেনি স্কুল ছাড়া অবধি। এইরকম অমানবিক অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতেই আমি কলেজবেলায় হাতিবাগানের বিবিধ হলে একেকদিন পরপর দুটো শোয়ে দুটো সিনেমাও দেখেছি!
যাইহোক, সেটা ছিল ১৯৮২ সাল। আমি সবে নতুন কনভেন্ট স্কুলের ক্লাস টুতে ভর্তি হয়েছি। সেই স্কুলে শিশু দিবস কিংবা বাৎসরিক ছুটি--- কারণটা আর মনে নেই--- উপলক্ষ্যে সিনেমা দেখানো হবে জানা গেল। সে একেবারে হইহই কান্ড আর রই রই ব্যাপার। সারা স্কুলের সমস্ত ছেলেপুলেকে নিয়ে গিয়ে বসানো হল একটা বিশাল হলে - সেটা চিত্তরঞ্জনের অফিসার্স কলোনির এক পাশে একটা বড় অনুষ্ঠান হওয়ার মতই হল ছিল। সেখানে একবার অন্তত আমাদের ওই স্কুলের বাৎসরিক অনুষ্ঠানও হয়েছিল মনে আছে।
মনে আছে, মাটিতে শতরঞ্জির উপর বসে, ঘাড় উঁচু করে , সামনের বিশাল স্ক্রিনে প্রোজেক্ট করা হিন্দি ছবি 'ধরমকাঁটা' আর তারপরে ইংরেজি ফ্যান্টাসি 'ডিগবি দ্য বিগেস্ট ডগ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড' হাঁ করে গোগ্রাসে গিলেছিলাম। বাকিরা কে কী দেখেছিল জানিনা। আমি যে খুব মন দিয়ে দেখেছিলাম সন্দেহ নেই, কারণ বহুদিন অবধি ধরমকাঁটা বলতেই মনে পড়ত একজন মেয়ে একটা কাঁচের স্টেজের উপর নাচ করছে। স্টেজটা যদি ভেঙে যায় তাহলে তার পা কাটবে কি না এইটা নিয়ে বোধহয় খুব চিন্তিত ছিলাম, তাই কিছু ঘোড়ায় চড়া ডাকাত আর ধুন্ধুমার মারপিট ছাড়াও ওই দৃশ্যটা ছায়াছায়া হয়ে মনের মধ্যে থেকে গেছল। অনেক অনেক পরে, একদিন কোনো একটা টিভি চ্যানেলে ধরমকাঁটা দেখানো হচ্ছে দেখে বেজায় পুলকিত হয়ে কাজকম্মো ফেলে রেখে সেটাকে দেখতে বসি এবং এক সময়ে সত্যিই দেখি যে ভিলেনের ডেরায় সুন্দরী বাইজি কাঁচের স্টেজের উপর নাচ করছে, ব্যাপারটা মোটেও আমার মনের মাধুরী সৃষ্ট নয়!
ডিগবির গল্পটা মজার ছিল। একটা মিষ্টি ছোট্ট খাট্টো, লম্বা লম্বা লোমে ঢাকা কুকুর কী যেন একটা এক্সপেরিমেন্টের ওষুধ ভুল করে খেয়ে ফেলেছিল, আর তার ফলে বড়ো হতে হতে তিন-চার তলা বাড়ির মত বড়ো হয়ে গেছিল। সিনেমার শেষে তাকে অ্যান্টিডোট দিয়ে আবার ছোট করে দেওয়া হয়। এই ছবির শেষের দিকের এক দৃশ্যে, বিশাল একটা কুকুর একটা রেল লাইনের উপর আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে আছে, তার সামনের আর পেছনের পা গুলো রেলের ট্র্যাকের দুইপাশে থামের মত রয়েছে, পেটটা যেন একটা টানেল, আর অনেক দূর থেকে একটা দ্রুতগতিতে আসতে থাকা ট্রেন তার পেটের তলা দিয়ে ঘসঘস ঝমঝম করে চলে গেল, তবুও ডিগবির গায়ে আঁচড় লাগল না, সে বেঁচে রইল, ট্রেনেরও কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হল না, আর আমি দম ফেলে বাঁচলাম --- এই পুরো দৃশ্যটা আজও চোখের সামনে ভাসে।
যদ্দুর মনে পড়ে, এমন 'এন্টারটেইনমেন্ট' দেওয়া হবে বলে বোধহয় আমাদের সবার থেকে অল্প করে চাঁদা চাওয়া হয়েছিল। একে তো সিনেমা দেখাবে, তার উপর আবার তার জন্য চাঁদা চাইছে স্কুল থেকে, বাবা এমনিতেই রেগেটেগে ছিলেন। তারপর যখন জানা গেল যে হিন্দি ছবিটার নাম ধরমকাঁটা, বলাই বাহুল্য, রাগের পারা চড়ল ।
কিন্তু তাতে আমার বয়েই গেছিল!