ছবি। উত্তর কলকাতা, হেদুয়া পাড়া

গতকাল বন্ধুদের সঙ্গে ফূর্তি করতে বেরিয়ে নিজের কলেজের পাশে পৌঁছে গেছিলাম। তাই সবাইকে টেনে নিয়ে বললাম চল চল, আমার কলেজের সামনে দিয়ে ঘুরে যাই। কলেজের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ্য করলাম উঁচু পাঁচিলের গায়ে টাঙানো এই ফ্লেক্স বিজ্ঞাপন। ছাত্রীদের পেয়িং গেস্ট ব্যবস্থায় অ্যাকোয়াগার্ড, সিসিটিভি, কাজের লোক, ফ্রিজের সুব্যবস্থা দেখে এক লহমায় টানা প্রায় চার বছর আমার বিবিধ বিচিত্র হোস্টেল-পেয়িং গেস্টে থাকার অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে গেল। চার বছর ধরে হাতেকলমে নানারকমের লাইফ স্কিল্‌স্‌ অর্জন করার পরে, ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় বছরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে কয়েকজন মিলে নিজেরাই মেস চালু করে দিয়েছিলাম। সকালে উঠে রান্না করে খেয়ে ক্লাস করতে চলে যেতাম। আমার পাঁচ বছরের হস্টেল জীবনে সেটাই সর্বাধিক সুব্যবস্থা ছিল বলা যায়।

কলেজ পেরিয়ে বিডন স্ট্রীটে ঢুকে হুজুগ করে নিজের প্রথম হোস্টেল খুঁজতে পুরনো পাড়ায় বন্ধুদের টেনে ঢোকালাম [ খুবই ভালো সব বন্ধু আমার, রাজিও হয়ে গেল, সঙ্গে চলেও চলল উৎসাহ নিয়ে] । সে পাড়া যে কী সাঙ্ঘাতিক পরিমাণে বদলে গেছে বলাই বাহুল্য। প্রাচীন ঝুলবারান্দাওয়ালা প্রায় ভেঙে পড়া বাড়ির পাশেই গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে একেবারে নতুন বাক্সবাড়ি। বিডন স্ট্রিটে থেকে ডান দিকে নয়নচাঁদ দত্ত স্ট্রিট হয়ে, অনাথ দেব লেনে আমাদের হোস্টেলে পৌঁছানোর গলিটা খুঁজেই পেলাম না। নিশ্চয় কোনো একটা বড় ফ্ল্যাটের সঙ্গে জুড়ে গেছে। যুগ যুগের ময়লা জমা সিমেন্ট ঘষা কালচে দেওয়ালের দুটো দুই বা তিন তলা বাড়ির মাঝের সেই সরু পায়ে চলা গলিতে মানুষ, কুকুর, বিড়াল ছাড়া, একমাত্র সাইকেল ঢোকা সম্ভব ছিল। গলির দুপাশে সম্ভবত ছিল সেইসব বাড়ির রান্নাঘর, বোঝা যেত না অবশ্য, কারণ বেশিরভাগ সময়ে একইরকমের ময়লা কাঠের পাল্লাগুলি ভেজানো থাকত। জানালার নীচে পড়ে থাকত শেষ পাতের এঁটোকাটা। নিঝুম দুপুরে সেইসব খেত কোনো কুকুর বা বিড়াল। উনুনের গুল-কয়লা, বাসী হয়ে যাওয়া মাছ-ভাত-সবজির গন্ধ, পাশের সরু নালার পচা জলের গন্ধ সব মিলেমিশে ঠিক সেই ঝিমধরা আঁশটে গন্ধটা তৈরি করত, যেটা আবার আমাদের চন্দননগরের বাড়ির গলিতেও মাঝেমধ্যেই পাওয়া যেত। কোনো কোনো নিঝুম দুপুরে কলেজ থেকে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ সেই গন্ধটা নাকে এলে আমি এক ঝটকায় আট-নয়-দশ বছরের কুটু হয়ে যেতাম, ওই শুকনো গলিটা চন্দননগরের বাড়ির কালো ইটের অল্প স্যাঁতসেঁতে গলি হয়ে যেত। আমার কাছে ব্যাপারটা অদ্ভূত ভালোলাগা তৈরি করত। হোস্টেলে ভর্তি করতে যাওয়ার সময়ে বাবা ডান দিকে হরি ঘোষ স্ট্রিটের একটা বাড়ি দেখিয়ে বলেছিলেন- এটা এক সময়ে আমার মামার বাড়ি ছিল। বাবা, দিদু, পিসিদের মুখ থেকে হরি ঘোষ স্ট্রিটের বাড়ির গল্প শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছি। বাবা নিজে স্কটিশ চার্চে কলেজ করেছেন, চৌমাথার বসন্ত কেবিনের গল্প শুনিয়েছেন। তাই ওই পাড়াটা আমার কাছে মনে মনে নিজের পাড়াই ছিল।

তবে গতকাল অনেকটা এগিয়ে গিয়ে, অনাথ দেব লেনে ঢুকেও বুঝলাম খুঁজতে হলে আরোও খানিক সময় ও শ্রম দিতে হবে। দুটোই আর দেওয়া সম্ভব ছিল না। তার আগে অবশ্য স্থানীয় একজন জানিয়েছেন সেই হোস্টেল আর নেই। কে জানে, তাই হবে হয়ত।

সাড়ে একত্রিশ বছর আগে, এই বিশাল মহানগরে, ওটাই আমার প্রথম 'পাড়া', প্রথম একা একা থাকার ঠাঁই ছিল।