------------------------------------------------------
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ –
১। সময় অমূল্য। ভেবে খরচা করুন। শেষে গিয়ে লোকসান হয়েছে মনে করলে এই পোস্ট, পোস্টের মালিক, পোস্ট সাঁটানো দেওয়াল বা দেওয়ালের মালিক, কেউই দায়ী নয়।
২। এই পোস্ট পড়লে অফিসে ইনক্রিমেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা নেই। না পড়লে কোনো এক্সোটিক দেবী শাপ দেবেন না।
--------------------------------------------------------------
গ্রীষ্ম থেকে বসন্ত, বছরভর আমি স্বেচ্ছায় ওটিটিতে একাধিক মেগাসিরিয়াল সিকি, আধা, পৌনে ভাগ দেখে থাকি।
এই বাক্যটি পড়েই যদি আপনার আমাকে ননআঁতেলেকচুয়াল, পাতে দেওয়ার অযোগ্য বা ফ্রেন্ডস লিস্ট থেকে বাতিলযোগ্য মনে হয় — প্লিজ আর পড়বেন না। বরং যান, এক কাপ চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফি বানিয়ে নিজের টাইমলাইনে নোম চমস্কির উক্তি — “If we don't believe in freedom of expression for people we despise, we don't believe in it at all.”— লিখে ফলোয়ারদের চমকিয়ে দিন।
গ্রীষ্ম থেকে বসন্ত, বছরভর আমি স্বেচ্ছায় ওটিটিতে একাধিক মেগাসিরিয়াল সিকি, আধা, পৌনে ভাগ দেখে থাকি। কাজকম্মের ফাঁকে ফাঁকে — পটলের ঝোল রান্না করতে করতে কিংবা ডিশওয়াশ জেলে জল গুলতে গুলতে; কুইলিং কিংবা সেলাই করতে করতে; ওয়েবসাইটের কন্টেন্ট কপি-পেস্ট করতে করতে; ইমেজ এডিট করতে করতে; হ্যাশট্যাগ আর মেটা ডেসক্রিপশন লিখতে লিখতে। আমি চপিং বোর্ড , ড্রয়িং খাতা কিংবা ল্যাপটপ স্ক্রীনের পাশে মোবাইল স্ক্রীন দাঁড় করিয়ে এমন চমৎকার মাল্টিটাস্কিং করতে পারি। মেগানায়িকাদের মত 'আমায় পারতেই হয়'। মেগাসিরিয়ালের নায়িকারা না খেয়ে না ঘুমিয়ে সংসারের ঊন কোটি চৌষট্টি কাজ করে তারপরেও শত্রুদের গুচ্ছ অন্যায়ের যাবতীয় প্রমাণ একা হাতে যোগাড় করে ফেলছে, আর আমি দুটো চোখ, দুটো কান, দুটো হাত আর দুটো প্রগতিশীল লেন্স থাকা সত্বেও দুটো কাজ পাশাপাশি হ্যান্ডল করতে পারব না! ছো! দুগ্গাপুজোর আগে রাশি রাশি বিজ্ঞাপনে এই-হাতে-আই-প্যাড-ওই-হাতে-খুন্তি-লাল-সাদা-বেনারসী-আঁচল-উড়ন্তি মার্কা মেয়েদের ছবিগুলো কি এমনি এমনি হাজির হয় না কি?
ও মা! আপনি এখনও পড়ছেন? কালো কফি বানিয়েছেন? খান না? তাহলে কি গ্রীন টি? ওটাও চলবে। কিঞ্চিৎ বিস্বাদ কিন্তু বেশ হাই এন্ড ব্যাপার। ভুঁড়ি এবং লাভ হ্যান্ডল্স্ কমিয়ে দেয় শুনেছি। চমস্কি দিয়ে চমকানো্র আইডিয়াটা পছন্দ হল না? তাই এদিকে টুক করে বাকিটা...? এই গেরামভারী ছদ্মবেশে থাকা মহিলা কি না শেষে গ্রাম-গঞ্জের মেয়ে বৌদের মত... ইয়ে , গ্রাম বলতে গ্রামশিকে মনে পড়ল। আন্তোনিও গ্রামশি। উনিও কিন্তু বেজায় কোটেব্ল্ , আর এই উক্তিটি বেশ চোখে ঝিলমিল লাগানোর মত — “The point of modernity is to live a life without illusions while not becoming disillusioned”। ওই যেখানে ফেসবুক প্রশ্ন করে - 'What's on your mind,...?' ওখানে থপাস করে এই লাইনটা সাঁটিয়ে দেখুন একবার আপনার সারাটাদিন কেমন ভালো যায়।
তো আসল কথাটা হল গিয়ে, আমারও , অন্তত নিজের সম্পর্কে, কোন্নোও ইল্যুশন নাই। আমি দু-চাট্টে মেগাসিরিয়ালের টুকরো টাকরা দেখি তাই।
দেখে-দেখে-দেখে দুয়েকটা ব্যাপার বুঝেছি।
এক, মেগাসিরিয়াল হল উপপাদ্যের মত। ওই যে, ক্লাস নাইন-টেন ... জ্যামিতি বাক্স... দুটো দশ নম্বর আর দুটো পাঁচ নম্বর ... পিথাগোরাস ইত্যাদি। আমি তো সেই তার পরে পরেই সেসব ত্যাগ দিয়েছিলাম, কিন্তু দেখছি ম্যাথেম্যাটিক্স আমার মাথায় পার্মানেন্ট ট্রমা রেখে গেছে। নইলে মেগাসিরিয়াল দেখতে বসে কারোর জ্যামিতি বাক্স, চাঁদা-কম্পাস, সূঁচালো পেন্সিল আর দিস্তা খাতা মনে পড়ে!
আরে, এই অবধি পড়ে ফেলেছেন! নাহঃ, আপনি নিজেকে যতই আলাদা প্রমাণ করার চেষ্টা করুন, ইউ আর ফেইলিং বস ! আমি কিন্তু জানি, গত সপ্তাহে আপনি 'জীবন সাদা-কালো, আমিও ভালো তুমিও ভালো' পাবলিক গ্রুপে চারশো শব্দের মধ্যে মেগাসিরিয়াল দেখার সঙ্গে নিম্নমেধার সমানুপাতিক সম্পর্কটা প্রমাণ করে 'সপ্তাহের সেরা আলোচক' সম্মাননা জিতেছেন। আপনার যত ফলোয়ার আর ফ্রান্ডজ, সব্বাই ঋদ্ধ, সমৃদ্ধ, বাকরুদ্ধ আর কেউ কেউ মনে মনে অপমানিত বোধ করে ক্রুদ্ধ হয়ে গেছে। আর সেই আপনি কি না মেগাসিরিয়াল নিয়ে এই বুড়ি-ভরা-কুমড়োর-মত-গড়িয়ে-চলা লেখাটা এতটা পড়ে ...মানে আপনি কি সত্যিই মেগাসিরিয়াল নিয়ে আগ্রহী? নাকি আসলে আগ্রহী নন? নাকি আগ্রহী কিন্তু দেখান যে আগ্রহী নন? নাকি আগ্রহী নন কিন্তু আমাকে দেখাতে চাইছেন যে আগ্রহী?... এই বিষয়ে না, দেরিদার একটা হেব্বি উক্তি আছে। আমি এইমাত্র গুগল খুঁজে এখানে কপি করে নিলাম। “To pretend, I actually do the thing: I have therefore only pretended to pretend.” আপনি এটা ট্রাই করতে পারেন। একটু জটিল। কিন্তু কে না জানে, যেসব কঠিন বক্তব্য সহজে বোঝা যায় না সেগুলির বাজারদর সবসময়ে বেশি।
মেগাসিরিয়ালে অবশ্য সবই খুব সহজে বোঝা যায়। তাই যেখানে ছিলাম সেখানে ফিরে আসি। মেগাসিরিয়াল হল উপপাদ্যের মত। মানে, এখানে একটা বিষয় প্রমাণ করা শুরুই হয় এক্স, ওয়াই ইত্যাদি ধরে নিয়ে। মানে, ধরুন,
প্রমাণ করো - শহরের কোটিপতি বড়লোক বাড়িতে ভুলক্রমে বৌ হয়ে আসা গ্রাম্য নায়িকা ফ্যাশন শো তে ক্যাটওয়াক করবে এবং প্রথম হবে।
ব্যাপারটা সাদা কাগজে চাঁদা-কম্পাস নিয়ে এইভাবে প্রমাণিত হয় —
ধরা যাক, এই দশ ফুট পাই পনেরো ফুট বাঁশ আর বিয়েবাড়ির প্যান্ডেলের কাপড় দিয়ে করা মঞ্চটা হল কলকাতার সবথেকে দামী এবং বড় ফ্যাশন শো-এর প্রফেশনাল র্যাম্প;
ধরা যাক, এই চড়া মেকআপ করা মহিলা ও গরমে ব্লেজার পরে ঘামতে থাকা পরচুলা পরা পুরুষ হলেন হেব্বি দামী বিচারক;
ধরা যাক, ওই লাল নীল ড্রেস পড়া রোগা রোগা আড়ষ্ট মেয়েগুলি একেকজন সুপারমডেল, যাদের নায়িকা হেলায় হারিয়ে দেবে;
ধরা যাক, এই যে খলনায়িকা লুকিয়ে নায়িকার শাড়ি ছিঁড়ে দেওয়া সত্বেও, হাপুসনয়নে কাঁদতে থাকা নায়িকা অন্য শাড়ি, রঙমেলানো ব্লাউজ আর মেকআপ সহ আধা মিনিটে ফট করে চলে এল, সেটা আসলে আধা মিনিট নয়, সেটা এক ঘন্টা;
ধরা যাক, দুপুরে কুড়ি জনের রান্নার জন্য ওই যে পাঁচ টুকরো মাছ দেখা যাচ্ছে, ওগুলো আসলে পাঁচ নয়, কুড়ি টুকরো;
ধরা যাক, কোটিপতি নায়কের আলমারিতে যে পাঁচটা জামা ঝুলছে, বাকিটা ফাঁকা, সেগুলি আসলে পাঁচটা নয়, পাঁচশোটা...
মেগাসিরিয়ালের এই প্রতি পদে সবকিছু ধরে নেওয়ার ব্যাপারটা খুবই সরল ব্যাপার। একবার ধরে নেওয়া অভ্যাস করতে পারলে বাকিটা ধাপে ধাপে মিলে সবকিছুই খুব সহজে প্রমাণিত হয়ে যাবে। দুচোখ ভরে দেখতে খুব ভালো লাগবে। মার্জিনের ধারে লাল কলমে গোল চিহ্নের মধ্যে দশে দশ লেখা থাকবে।
একের পরে দুই যেটা — মেগাসিরিয়ালের নায়িকা হল আপগ্রেডেড লাইভ ভার্সন অফ দশপ্রহরণধারিণী। একেবারে চাইনিজ পলিয়েস্টার সুতো দিয়ে পাওয়ারলুমে বোনা হ্যান্ডলুম জামদানি শাড়ির মত হোমগ্রোওন অ্যাভেঞ্জার। কালো কফি কিংবা গ্রীন টি তো দূর অস্ত, সকালবেলায় সংসারের সাড়ে পনেরোজন সদস্যের জন্য মিনি কড়াইতে ছয়জনের আলুচচ্চড়ি আর পাঁচটা লুচি বানানোর পরেও, নিজে কখনও বেরেকফাস, লাঞ্চ বা ডিনার করে না।
এ-এ-এ রোক্কে! লাঞ্চ ডিনারের কথায় এসে আবার আপনার কথা মনে পড়ল। এখনও আছেন নাকি আমার টাইমলাইনে? আর ভাবছেন , এই-ই ভাটের তত্ব পড়ার জন্য কয়েকটা জরুরী মিনিট নষ্ট করলাম। এর বদলে 'ইন্স্পিরেশনাল কোট্স্' কিংবা 'হাউ টু অলওয়েজ বি আ উইনার' পেজে ঘুরে এলে কাজে দিত? ভাববেন না বস্ আপনার জন্য আমি খুঁজে পেতে একটা সেরিব্রাল কোটেশন নিয়ে এসেছি। এটা আপনার মনের মত হবে, একেবারে শিওর - “What the mass media offers is not popular art, but entertainment which is intended to be consumed like food, forgotten, and replaced by a new dish.” - এই একেবারে লাঞ্চ-ডিনারের সঙ্গে তাল রেখে বলা মনের মত লাইনটা হল অডেনদার উক্তি। এটা নিজের দেওয়ালে সাঁটালে 'পপুলার আর্ট' আর 'এন্টারটেইনমেন্ট' এর তফাৎ কী, সেটা নিয়ে আপনার টাইমলাইনে দশদিক থেকে চেনা অচেনা জনগণ এসে বেজায় তর্ক করতে পারে কিন্তু। কী হল, চটে যাচ্ছেন কেন? ও আচ্ছা! র্যান্ডম লোকজন সত্যজিৎ রায়কে মানিকদা বলে উল্লেখ করতে পারে, আর আমি ডব্লিউ এইচ অডেন কে অডেনদা বলে ডাকলেই যত দোষ?
হ্যাঁ, যেখানে ছিলাম — নায়িকা খায়না, ঘুমায় না, সারাদিন ঘরের সব কাজ করে, আজকাল আবার 'এম্পাওয়ার্ড' বলে ঘরে এতকিছু করে বাইরেও কাজ করতে যায় কিংবা কলেজে ভর্তি হয়, কিন্তু কাজে যাওয়ার সময়ে ভুলে ব্যাগ বা পার্স নিয়ে বেরোয় না; মাঝে মাঝে মোবাইল ও ভুলে যায়। যদি সারাদিন মোবাইল হাতে থাকেও, ইন্টারনেটে সার্চ করতে হলে বর কিংবা দেওরের সাহায্য নেয়। পাঁচালি কিংবা পুজোর গান ইত্যাদি মুখস্থ রাখাটা অবশ্য জন্মগত ক্যালিবার। দিন হোক বা রাত, শপিং মল হোক বা ভিলেনের আস্তানা, তাদের মেকআপ সরেনা কিংবা খোলা চুল যেমন টান টান থাকার কথা তেমনই থাকে; রান্নাঘরে খিচুড়ি রাঁধা কিংবা রাস্তায় 'আমায় পারতেই হবে' বলে উদ্ভ্রান্ত হয়ে দৌড়ানো — সবসময়েই তাদের শাড়ির আঁচল শৈল্পিকভাবে পায়ের কাছে লুটাতে থাকে। এরকম 'রিল লাইফ'-এর নায়িকার মত কোনোটাই আমি করে উঠতে পারলাম না কিংবা আমার হল না বলে আমার রিয়েল লাইফটাও কেমন যেন ম্যাদা মেরে গেল।
মেগাসিরিয়ালের কাহিনি যদি উপপাদ্য হয়, তাহলে এই পুরো ব্যাপারটা —নায়িকা বা 'ফিমেল প্রোটাগোনিস্ট'-এর এই পুরো প্রেজেন্টেশনটা আসলে হল গিয়ে 'সম্পাদ্য'। নিখুঁত ভাবে, পরিষ্কার পাতায় ছবিটা এঁকে ফেলে প্রমাণ করে দেওয়া হয় — যে ছবিটা এঁকেছি, সেটা ঠিক। এই দেখো — স্কেল মেপে দেখিয়ে দিচ্ছি, আড়ে -দীর্ঘে স-অ-ব ঠিক আছে। ঠিক যেমনটি হলে বাজারনির্মিত দর্শককুলের দৃশ্যসুখ বৃদ্ধি পায়। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি চেহারা; আওয়ারগ্লাস শরীর; এক মাথা চুল; লাইনার টানা চোখ; ডিজাইনার ইউনিফর্ম; কটকট করে কথা বলে; ছেলেবুড়ো সবাইকে গায়ে পড়ে সাহায্য করে; পড়াশোনায় ভালো; গাছে চড়তে পারে; ইলেকট্রিকের বাল্ব বদলাতে পারে; গোয়েন্দার মত বুদ্ধি আর পুলিশের মত সাহস আছে; বিনা ট্রেনিং এ বন্দুক চালাতে পারে; একজন প্রি-ডিফাইন্ড আরাধ্য দেবতা বা দেবী আছে; র্যান্ডম ফুলস্কেল উপোস করার অভ্যাস আছে; মাথায় হঠাৎ আকাশ ভেঙে সিঁদুর পড়লে ইমোশনাল মেটামরফোসিস হয়ে যায়; আরশোলা/টিকটিকি দেখলে অবশ্যই ভয় পায়; আর ঝড়বৃষ্টির পটভূমিতে দুড়ু-উ-ম-ম-ম করে বাজ পড়লে খু-উ-ব ভয় পেয়ে দৌড়ে নায়কের বুকে আশ্রয় নেবেই নেবে।
মাঝেমধ্যে এহেন 'আদর্শ' ক্রাইটেরিয়ার বাইরে যেসব সম্পাদ্য আঁকার চেষ্টা করা হয়, সেগুলি হল আপাতভাবে এক্সেপশন্স, ওনলি টু প্রুভ দ্য রুল।
ও বস! আছেন তো? দাঁড়ান এখানেও খাপে খাপ হয়ে বসে যাবে এমন একটা লাইন ঢুকিয়ে দিতে পারলে ভালো হত। কিন্তু জম্পেশ কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। জোড়াতালি মেরে , ওপর ওপর পড়াশোনা করে আর গুগল খুঁজে কপি করে কি আর অজ্জিনাল কন্টেন্ট তৈরি করা অত সহজ ! তাহলে তো প্রতি সপ্তাহে যত ওয়েব সিরিজে ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো ছেয়ে যাচ্ছে, সবগুলোই সুপারহিট হত। দেখুন, শুধুমাত্র আপনার জন্য আমাকে কত এক্সট্রা খাটতে হচ্ছে, আমার লেখার ফ্লো আটকে যাচ্ছে। কিন্তু আপাতত আমি পেয়ে গেছি, একখানা জবরদস্ত এবং একেবারে প্রযোজ্য বক্তব্য — “In a world ordered by sexual imbalance, pleasure in looking has been split between active/male and passive/female. The determining male gaze projects its phantasy on to the female form which is styled accordingly. In their traditional exhibitionist role women are simultaneously looked at and displayed, with their appearance coded for strong visual and erotic impact so that they can be said to connote to-be-looked-at-ness.” একটা ব্যাপার খেয়াল করেছেন তো? বাকিদের উক্তিগুলো এক লাইনে শেষ; এখানে একাধিক লাইন। মহিলার উক্তি কি না! আমি তো একটু হেলে থাকবই। ভালো কথা বলছি, নারীবাদী চলচ্চিত্রতাত্বিক লরা মাল্ভির এই কোটেশনটা কপি করে গুগল কীপ এ রেখে দিন, সময় সুযোগ বুঝে নিজের দেওয়ালে বিবিধ পোস্ট এবং পোস্টারের মাঝে সাঁটিয়ে দেখবেন একবার, কেমন আপনার প্রোফাইলে ফুটফল বেড়ে যায়!
দিওয়ালি বা বড়দিনের দুপুরে —আগেই-ওটিটি-এবং-হলে-রিলিজ-হয়ে-যাওয়া-কিন্তু-আবার-মেগা-টেলেভিশন-ওয়ার্ল্ড-রিলিজ-হওয়া-সুপারহিট-ছবি — চলাকালীন মাঝে সুদীর্ঘ বিজ্ঞাপন বিরতির মত এমন লম্বা পোস্ট লেখার ইচ্ছে আমার মোটেও ছিল না। আমি অংকে লবডঙ্কা, মাস্টারমশাই ঘাড়ে ধরে দুইবছর টানা অনুশীলন করিয়েছিলেন বলে কী করে যেন মাধ্যমিকে অংকে ভালো নম্বর পেয়ে পাশ দিয়েছিলাম। জ্যামিতি মন্দ লাগত না। তাই উপপাদ্য আর মেগাসিরিয়ালের মিল নিয়ে হালকা করে দু-চার লাইন লেখার সাহস করেছিলাম। নইলে আমার অংক নিয়ে লেখা তো আবার ওই 'মেগাসিরিয়াল কেন উপপাদ্য' প্রমাণ করার মতই হয়ে যাবে... ধরা যাক, ম-এর অংকে খুব মাথা !
কিন্তু মধ্যেখানে বস্ , আপনাকে ইম্প্রেস করতে গিয়ে, জ্ঞানীগুণী মানুষজনের কিছু কথাবার্তা ঢুকে গেল। ওই সাবান-টুথপেস্ট-ঘড়ি-পিৎজা-জীবনবিমার মাঝে যেমন জরুরী সরকারি বিবিধ সচেতনতার বিজ্ঞাপন চলে আসে, সেইরকম। আমাদের বেড়ে ওঠার বয়সে সত্যিই আসত তেমন সব জরুরী সমাজ বা স্বাস্থ্য সচেতনতার বিজ্ঞাপন। এখন অবশ্য সেসবের সংখ্যা কম, নেই বললেই চলে। এখন শুধুই 'ইম্প্রেশন' আর 'রীচ' এর হিসেব-নিকেশ, তাই না?
আমার বালিকাবয়সের টেলেভিশন দেখার স্মৃতি মূলতঃ মধুর। প্রচুর সুস্থ অনুষ্ঠান এবং ধারাবাহিক দেখেছি, সেসব আজও মনে থেকে গেছে। তাই আশির দশকের ভারতীয় টেলিভিশন, বা বলা ভালো দূরদর্শনকে আমার কখনও বোকা বাক্স বলে মনে হয়নি। তারপরে অবশ্য অনেক কিছু বদলে গেছে। অডিও-ভিস্যুয়াল মিডিয়া আমার পছন্দের পড়াশোনার বিষয়। আমার কিছু বন্ধু টেলেভিশন বা এখন ওয়েব প্ল্যাটফর্মে অডিও ভিস্যুয়াল কন্টেন্ট তৈরির কাজে সফলভাবে যুক্ত। এই দেশে গত নব্বইয়ের দশক থেকে টেলেভিশনের মত শক্তিশালী এক মাধ্যমকে ব্যবহার করার ধরণ ব্যাপকভাবে বদলেছে। আমি নিজের সুবিধামত টেলেভিশনের এবং ওয়েবে প্রসারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান অল্পস্বল্প দেখে সেই বদলের কারণ-প্রকরণের আন্দাজ নেওয়ার চেষ্টা করি। বেশিরভাগটাই মনোমত নয়। তবুও টেলেভিশন বা অডিও ভিস্যুয়াল মিডিয়া সম্পর্কে আমি মনঃক্ষুণ্ন কিন্তু সচেতনভাবে আগ্রহী।
“If you want to use television to teach somebody, you must first teach how to use television.” — ও বস্, এটা উমবের্তো একোর কথা। দেখুন শেষ করার আগেও আপনাকে মনে রেখেছি। এতদূর যখন সঙ্গে এসেছেন, তখন শেষ অবধি আপনার যেন না মনে হয় এই গত সাড়ে নয় মিনিট জলে গেল — এটা দেখা আমারও কর্তব্য। ফ্রি টেকঅ্যাওয়ে না থাকলে অন্যের দেওয়ালে আটকে থেকে লাভ কী? ঠিক একই কারণেই তো ভালো মেগাসিরিয়ালের শেষে গিয়ে যার সঙ্গে যার সম্ভব — সব্বার বিয়ে হয়ে যায়, শত্রুরা সবাই বন্ধু হয়ে যায় আর অপ্রয়োজনীয় সব চরিত্ররা হয় মরে যায় নইলে ডক্টর হাজরার মত জাস্ট ভ্যানিশ হয়ে যায়। আমিও তাই সব গুছিয়ে শেষ করছি। সব সুতো গুটিয়ে ফেলেছি। শুধু এই শেষের খুঁজে পাওয়া উক্তিটি আমাকে একটু বেশিই ভাবালো। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, কারা যে কাদের কীভাবে টেলেভিশন ব্যবহার করার কী কী শিক্ষা দিচ্ছে সেটা নিয়ে যদি আর একটা পোস্ট লিখি, কে জানে, আমার অ্যাকাউন্টটাই হয়ত ফেসবুক থেকে ভ্যানিশ হয়ে যাবে। তখন আমার কী হবে!
ছবি সৌজন্যঃ দ্য এশিয়ান এজ অনলাইন