২০২০ তে অবশ্য দেখিনি, সেবছরের লকডাউন আমি ইউটিউব থেকে একের পর এক হিন্দি ডাবিং এর তামিল-তেলুগু-মালয়ালম-কন্নড ছবি দেখে কাটিয়েছি। কয়েকটা অদ্ভূত ভালো ছবি দেখেছি, কয়েকটা পাঁচ মিনিট দেখেই --- ওম্মা...এটা সেই গত রোববার দুপুরের জিৎ-এর ফিল্মটা না? - বলে বন্ধ করে আরেকটা খুলেছি। কিন্তু ২০২১ -এ এসে নিজেকে একটু আপডেটেড রাখার উদ্দেশ্যে ওই ওপরের সাদা-জোব্বা-কালো-জোব্বা ফেজের মধ্যে দিয়ে মাঝে মাঝে যাই। এমন করেই দুটো ওয়েব সিরিজ কয়েকদিন আগেই দেখেছি, দেখে বেশ মজা লেগেছে, তাই তাদের নিয়ে দুচার কথা লিখছি।

এখানে একটা বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়ে রাখা দরকারঃ আপনি যদি অপরাধ-খুন-যৌনতা-পরকীয়া বাদ দিয়ে, আধো-অন্ধকার- ম্যাটমেটে-ফ্যাকাশে-হলদে-সবুজ-আলোছায়ামাখা সেট বাদ দিয়ে, বেশ আলো আলো, খানিক রহস্য রোমাঞ্চ থাকলেও, মূলতঃ 'ফিল গুড' সিরিজ দেখতে চান, তো এ দুটি দেখতে পারেন। এদেরও স্ক্রিপ্টে এদিক সেদিক কিছু গন্ডগোল আছে, তবুও --- 'দেখতে কোনো বাধা নেই, দেখলেই যে ভালো লাগতে হবে এমন কোনো কথা নেই' । সব থেকে বড় কথা হল, 'সিজন টু' নেই ( মানে এখনও নেই )। আর যদি আপনার এসবে অরুচি থাকে, তাহলে এই লেখার বাকিটা পড়ে কাজ নেই।

এক নম্বর সিরিজ হল 'কৌন বনেগি শিখরওয়াতি'। দেখতে শুরু করেছিলাম শুধুমাত্র স্টার অভিনেতাদের তালিকা দেখে- নাসিরুদ্দিন শাহ, রঘুবীর যাদব, লারা দত্ত, সোহা আলি খানের সঙ্গে আরও একগুচ্ছ নতুন-পুরনো শিল্পী আছেন। এটাকে একখানা আধুনিক রূপকথা বলা যায়। রাজস্থানের 'নামে তালপুকুর ঘটি ডোবে না' গোছের এক রাজ্যের রাজা ভারত সরকারের কাছ থেকে চিঠি পান যে প্রচুর কর বাকি আর না দিতে পারলে তাঁর রাজপ্রাসাদ সরকার অধিগ্রহণ করবে। তিনি বুঝলেন, এই সমস্যার সমাধান করতে তাঁর নিজের সন্তানদের সাহায্য প্রয়োজন। তিনি নিজের চার মেয়ে --- যারা অতীতের কোনো ঘটনার কারণে একে অপরের থেকে এবং বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন --- তাদের ডেকে পাঠান এবং বলেন নবরসের ভিত্তিতে হওয়া নয়টি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে যে নিজেকে সবথেকে পারদর্শী প্রমাণ করবে, সে হবে 'শিখরওয়াতি'- সব সম্পত্তির মালিক। মেয়েদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অনেক টাকার দরকার, তাই তারা আসে, এবং গল্প প্রতি পর্বে নতুন বাঁক নেয়। শেষ অবধি অবশ্য গল্পটা যত ভালো হবে ভেবেছিলাম তত ভালো হয়নি, কিন্তু শুধুমাত্র রঘুবীর যাদবের অভিনয় দেখার জন্যেই এই সিরিজটা দেখা যেতে পারে। সঙ্গে রয়েছে রাজস্থানের সুন্দর সব লোকেশন, আর বেশিরভাগ আলো ঝলমল দৃশ্য।

দ্বিতীয় সিরিজটির নাম 'দিল বেকরার' । রাজ বব্বর, পুনম ধীলোঁ, সুহেল শেঠ আর পদ্মিনী কোলাপুরে রয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে। এটা আমার বেশ ভালো লেগেছে। আশির দশকের পটভূমিতে নির্মিত এই সিরিজ জুড়ে আমাদের শৈশব -কৈশোরের টুকরো টুকরো স্মৃতি মাখানো --- বিশেষতঃ টেলেভিশন- রেডিও-বিজ্ঞাপন- ছায়াছবির গান- সেই বাক্স টিভি, তারওয়ালা ডায়াল ঘোরানো ফোন, অ্যাম্বাসেডর গাড়ি... সঙ্গে সেই দূরদর্শনের রাতের খবরের ঝকঝকে ইংরেজি বলা- ক্রেপ বা শিফন শাড়ি পরা সংবাদপাঠিকারা... আরও এমন বেশ কিছু ছোট্ট ছোট্ট স্মৃতি উস্কে দিল এই সিরিজটি। অত্যন্ত স্মার্ট এডিটিং - আশির দশকের টেলিভিশনে যেমন ট্রান্সিশন এফেক্ট দেখা যেত, ঠিক তেমন ব্যবহার করা হয়েছে গোটা সিরিজ জুড়ে। অমিন সায়ানির ধারায় ন্যারেশন এসেছে একেক সময়ে। নায়িকা সাংবাদপাঠিকা দেবযানী ঠাকুর যখন খোঁপায় গোলাপ ফুল্ লাগিয়ে খবর পড়তে গেল, খুব আবছা ভাবে মনে হল,হিন্দি খবর পড়তেন সল্‌মা সুলতান - তিনিও অমন ফুল লাগাতেন মনে হয় ... পরে গুগ্‌ল্‌ ঘেঁটে দেখলাম ঠিকই মনে রেখেছি প্রায় চার দশক আগের স্মৃতি।

সিরিজটি দেখতে দেখতে কেন কে জানে আমার বাসু চ্যাটার্জি 'খট্টা-মিঠা' ছবিটার কথা মনে পড়ছিল- সম্ভবত নায়কের চেহারার মধ্যে রাকেশ রোশনের আদল খুঁজে পাচ্ছিলাম বলে।কিছু কিছু জায়গাতে মনে ধন্ধ জেগেছে - তখন এমন পোষাক ছিল? এমন খাবার ছিল?পরে মনে হয়েছে, আশির দশকে মফস্বলে বেড়ে ওঠা মেয়েটার কাছে 'দিল্লি' যা ছিল, আজও মোটামুটি তাই আছে। তার ওপরে 'সাউথ দিল্লি' সম্পরকে প্রায় কোনো ধারণাই নেই আমার। তাই আশির দশকের দিল্লির অভিজাত পরিবারের ছেলেমেয়েদের জীবনযাত্রা, পোষাক, খাবার বা বিনোদন যেভাবে দেখানো হয়েছে সেটাকে ঠিকই ধরে নিতে হবে।

তবে এই সিরিজ চমক দিয়েছে অন্য জায়গাতে। এখানেও আছে এক দুষ্টু মন্ত্রী, নাম তার 'মিঃ মোট্‌লা'। তো এই মোটলাসাহেব নিজের বক্তব্যের মধ্যে 'সার্জিকাল স্ট্রাইক', 'অ্যান্টি-ন্যাশনাল', 'প্রো প্রাইভেটাইজেশন' ,'নেশন ওয়ান্টস টু নো' ইত্যাদি ব্যবহার করেন। আর অমনি দর্শক ঝাঁকুনি খেয়ে নড়ে চড়ে বসে। স্ক্রিপ্ট এর মধ্যে ছোট্ট ছোট্ট কথায় জে এন ইউ এর মেধাবী ছাত্রকে কীভাবে আতংকবাদী প্রমাণ করতে হয় ,কিংবা জেলে ঢুকে জল খাওয়ার জন্য স্ট্র চাইলে সেটাও দেওয়া হবে না --- এমন সব প্রবল বাস্তব - যা হয়ত অন্য চেহারায় আশির দশকেও সত্য ছিল, আজ আরেক চেহারায় সত্য--- গুঁজে দেওয়া হয়। তবে এই সিরিজটিতে দুষ্টু মন্ত্রী থাকলেও এটা পলিটিকাল থ্রিলার নয়, বরং হাল্কা মেজাজের রোমান্টিক কমেডি।

শুধু সিরিজটা শেষ হওয়ার পরে মনে হল --- 'আশির দশক'-এর পটভূমিতে গল্প বলে ট্রেলার শুরু হচ্ছে , তার মানে মেঘে মেঘে বেলা সত্যিই অনেক হল নাকি?