গত কয়েকদিন ধরে যখনি বৃষ্টি পড়ছে, মাঝে মাঝেই ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মত হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার একটা ঘটনা বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে…প্রতি বর্ষাতেই পড়ে…আমার আর ভাইয়ের ঝুলন সাজানোর কথা। এবারো যখন মনে পড়ল, তখন ভাবলাম একেবারে ভুলে যাওয়ার আগে লিখে রাখি আমার সেই সব স্মৃতি। এইসব ভাবতে ভাবতেই, গতকাল ক্যালেন্ডারের পাতায় চোখ বোলাতে গিয়ে দেখেছিলাম আজ ঝুলনযাত্রা। ঝুলন পূর্ণিমার দিনে হয় বলে একটা ভুল ধারনা ছিল, দেখলাম আজ কিন্তু পূর্ণিমা নয়…ভুল ধারনা তো হওয়ার কথা নয়…স্পষ্ট মনে আছে ‘রাজকাহিনী’তে পড়া বাপ্পাদিত্যের সঙ্গে সেই রাজকন্যার ঝুলন উৎসবের কথা…সেট তো পূর্ণিমা রাত ই ছিল…টাইপ করা থামিয়ে উঠে গিয়ে ধুলো ঝেড়ে বার করলাম আমার সেই প্রিয় বই…আর হ্যাঁ, ঠিকই তো…অবনীন্দ্রনাথ তো সত্যি লিখেছেন পূর্ণিমার রাতে শোলাঙ্কি রাজকুমারির সাথে বাপ্পাদিত্যের ঝুলন খেলার গল্প ।…তাহলে ক্যালেন্ডার আজকের দিনটা পূর্ণিমা দেখাচ্ছে না কেন? …অতএব ভরসা গুগল!!দেখলাম অনলাইন পঞ্জিকা বলছে ৩১শে জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট হচ্ছে ঝুলনযাত্রা! এতদিন? কি আশ্চর্য! তারমানে তো একটা পূর্নিমা এসেই যাচ্ছে এর মধ্যে…ওহো…৫ তারিখ তো দেখছি আবার রাখী পূর্ণিমা…।তাহলে কি সেইদিন ই ঝুলনপূর্ণিমাও?… দুই একটি ওয়েবপেজ সার্ফ করে বুঝলাম ৫ তারিখ হচ্ছে শ্রাবণ পূর্ণিমা, সেইদিন ই রাখী, আবার সেইদিন ই ঝুলনপূর্নিমাও বটে। আসলে একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর থেকেই, রাখীর সঙ্গে সম্পর্ক থেকে গেছিল, কিন্তু ঝুলন পালন করার অভ্যাসটা যেন কি করে হারিয়ে গেছিল…হয়ত মা বলেছিলেন…বড় হয়ে গেছ, আর ঝুলন করতে হবে না…পড়াশোনার ক্ষতি হবে…তাই বড় হতে হতে আর ছোটবেলাকে পেছনে রেখে নিরন্তর এগিয়ে চলার মাঝে ঝুলন যে কবে হয় সেটাই ভুলে গেছিলাম কতদিনের জন্য…শুধু এটুকু মনে ছিল যে ঝুলনের দিন খুব বৃষ্টি হয়…

কিন্তু তার আগে…সেই সাত-আট-দশ বছর বয়সে…তখন কিন্তু রাধা-কৃষ্ণের লীলা-মাহাত্ম্য নিয়ে মোটেও চিন্তিত থাকতাম না। ঝুলন মানে হল আমাদের মফস্বলী কোয়ার্টারের সামনের একচিলতে বাঁধানো জায়গাটুকুতে ঘাস, মাটি, পাথর, ফুল, পাতা আর যত রাজ্যের খেলনা দিয়ে সাজিয়ে ফেলা…কখনো শহর, কখনও গ্রাম, আমাদের একান্ত নিজস্ব এক রূপকথার দেশ।তার মাঝখানে বসবেন কৃষ্ণঠাকুর, আর সন্ধ্যাবেলা মা দেবেন নকুলদানার হরির লুঠ। আমার সব বন্ধুরাই তাদের সাধ্যমত সাজাতো তাদের ঝুলনের আসর। আমরা আবার একে অপরের বাড়ি যেতাম ঝুলন সাজানো দেখতে।

আগের দিন থেকে শুরু হত আসর সাজানোর, আমাদের ভাষায় ‘ঝুলন সাজানোর’ সরঞ্জাম যোগাড় করার পালা। কোথায় নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে, সেখান থেকে বালি…রাস্তার ধারে জমা করা কালো কালো খোলামকুচি…কাদামাটি…বর্ষার জল পেয়ে হটাৎ মাটি ফুঁড়ে ওঠা অন্যরকমের ঘাসের ঝাড়, যার ডগাগুলি ধরে একটু নাড়া দিলেই শিকড় শুদ্ধ উঠে আসে…এই ঘাসগুলির চাহিদা ছিল খুব বেশি, কারন দেখতে খুব সুন্দর ছিল। বন্ধুদের মধ্যে রীতিমত প্রতি্যোগিতা চলত কে কটা ঘাস-গাছ খুঁজে পেল… ঝুলনের দিন স্কুল থেকে ফিরতে যেন আর তর সইত না। দুপুরবেলা খাওয়া কোন রকমে শেষ করেই শুরু হয়ে যেত প্রস্তুতি। এই বিষয়ে আমাদের প্রধান উৎসাহদাতা আর উপদেষ্টা ছিলেন আমার মা। দেওয়ালের গায়ে বালি-কাদা চেপে চেপে তৈরি হল পাহাড়, তার গায়ে মাঝে মাঝে স্টোন চিপস…পাহাড়ের গায়ে পাথর…বালি দিয়ে রাস্তা…নীল পলিথিনের বাটির মধ্যে জল ভরে পুকুর, চারিপাশে ঘাস-মাটি দিয়ে বাটিকে ঢেকে দেওয়া হল…একদিকে প্রচুর গাছের ডাল দিয়ে জঙ্গল…তারপর সেই রাস্তায় নামলো প্লাস্টিকের গরুর গাড়ি, পাহাড়ে চড়ার চেষ্টা করতে লাগলো লাল রঙের চার-চাকা…পুকুরে ভাসল খেলনার সাদা হাঁস আর জঙ্গল থেকে উঁকি দিল হলুদ কালো প্লাস্টিকের বাঘ…এক কোনে বসল স্কুলের হাতের কাজে তৈরি করা কার্ডবোর্ডের কুঁড়েঘর, তার সামনে মাটির পেটমোটা টিকিধারী পন্ডিত…এইরকম আরো কত কি… মাঝখানে একজায়গায় বসলেন মায়ের গোপালঠাকুর। এইসব সাজানোয় ওস্তাদ ছিল আমাদের দেখাশোনা করত যে – সেই রক্তিদাদা। রক্তিদাদা সেই সময়ে ১৩-১৪ বছরের ছিল। একবার মনে আছে, সব সাজানো হয়ে যাওয়ার পরে রক্তিদাদা বিকেলবেলা গোয়ালার থেকে দুধ নিয়ে ফেরার পথে কোথা থেকে বা তুলে এনেছিল মাটির চাঙড় শুদ্ধ লম্বা লম্বা ঘাস। সেই ঘাস দিয়ে সাজানোর পরে আমাদের সেই ছোট্ট বৃন্দাবনের চেহারাই পালটে গেছিল! সবাই এসে জিজ্ঞের করেছিল এইরকম ঘাস কোথা থেকে পেলাম আমরা। আমার পরিষ্কার মনে আছে, অন্যদের থেকে আলাদা হওয়ার গর্বে আমার ছোট্ট বুকটা খুশিতে ভরে গেছিল।

সন্ধ্যে হওয়ার আগে বাবা একটা তার টেনে সেই ঝুলনের আসরের ওপর আলো লাগিয়ে দিতেন। আর সন্ধ্যা হলে মা দিতেন নকুলদানা-বাতাসার হরির লুঠ। আমি, ভাই, রক্তিদাদা আর যদি আর কোন বন্ধু থাকত , সবাই মিলে হই হই করে কাড়াকাড়ি করে কুড়োতাম সেই মুঠিভরা আনন্দ।

তারপর বন্ধুদের বাড়ি যেতাম তারা কেমন সাজিয়েছে দেখতে…বেশিরভাগ সময়ই নিজেদেরটাকেই মনে মনে সব থেকে ভালোর খেতাবটা দিয়ে দিতাম। একবার মনে আছে, আমার বন্ধু মাম এর বাড়ি গিয়ে দেখলাম, নানা রকম জিনিষ দিয়ে সাজানো ঝুলনের মধ্যে একদিকে কতগুলি জলপাই সবুজ রঙের ছোট ছোট প্লাস্টিকের যুদ্ধরত সৈন্য। বল্লাম – এগুলো কেন দিয়েছিস? মামা বললো- ওদিকে যুদ্ধ হচ্ছে। অন্যদিকে তাকিয়ে দেখি অতি পরিচিত ভঙ্গীতে, পিছনে হাত দিয়ে, সামনের দিকে ইষৎ ঝুঁকে, গম্ভীর মুখে সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কালো প্লাস্টার অফ প্যারিসের রবি ঠাকুর…মাপের অনুপাতে তিনি সৈন্যদের থেকে বেশ বড়। বললাম – রবীন্দ্রনাথ কেন? মাম বললো- উনি ভাবছেন।

সেদিন মামের জন্য একটু দুঃখ হয়েছিল…ওর আমার মত নানারকম খেলনা নেই বলে শেষ অবধি কিনা ছোট্ট ছোট্ট সৈন্য আর মাপে বড় রবীন্দ্রনাথের মূর্তি!- আমি কি জানিনা ওটা মোটেও ওর খেলনা নয়, ওটা ওদের বসার ঘরে বইয়ের তাকে রাখা থাকে…আর ওই সৈন্যগুলিও তো ওদের সাঁজোয়া গাড়ি সমেত শোকেসে রাখা থাকে… আশ্চর্যের বিষয়, সেই একটা দৃশ্য কিন্তু আমার মনে এখনও পরিষ্কার থেকে গেছে…এবং অদ্ভূত ভাবে মাঝে মাঝেই মনে পড়ে… আজ আমি জানি, সেদিন মামের ওই খেলনা সাজানোর ভাবনার পেছনে ছিল ওর বাড়ির বড়দের ভাবনা চিন্তা, যেমন আমাদের ও থাকত…সেই ভাবনা আর সেই বিন্যাসের প্রাসঙ্গিকতা আজও কি ভীষণ সত্যি…কতরকমভাবে সত্যি…

এখন আর ছোটরা ঝুলন সাজায় কিনা জানিনা। আমার চারপাশের ছোটদের তো কাউকেই দেখিনা এই আনন্দ উপভোগ করতে…মনে হয় তারা জানেও না এইরকম একটা উৎসব ছিল বা আছে। আমার সেই ছোটবেলার কোন এক ঝুলনযাত্রার দিন খুব বৃষ্টি পড়েছিল, ধারালো ছাঁটে ভিজে গিয়েছিল ঘাস-মাটি-ফুল-খেলনা…রাতের বেলা সব উঠিয়ে রাখার সময় দেখতে পেলাম পেটমোটা পন্ডিতমশাই জলে ভিজে গলে গেছে তলার দিকে…কাঁচা মাটির পুতুলের গা থেকে হাতে উঠে এসে লেগেছিল নীল-সবুজ রঙ। কলের জলের ধারার নীচে ধুয়ে যাওয়া সেই রঙের মতই হারিয়ে গেছে সেই ভালোলাগার উৎসব…

এই পোস্ট একই সঙ্গে “আমারব্লগ” এও প্রকাশিত হয়েছে।

প্রথম পোস্ট হয়েছিল, ৯ই জুলাই, ২০০৯