আমার ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে একটা টেপ-রেকর্ডার ছিল। বাবার শখ ছিল নানাধরনের গান শোনার। একদিন বাবা বাজার থেকে কয়েকটা ক্যাসেট নিয়ে এলেন। সেগুলি গানের নয়। সেগুলির ওপরে ছিল এক চেনা মুখের ছবি। বড় বড় চোখ, লম্বাটে গঠন, আর এক অদ্ভূত মজাদার নির্মল হাসি। তিনি আমাদের চেনা। বাড়িতে বাংলা এবং হিন্দি ছবি দেখার ব্যাপারে ঘোরতর নিষেধাজ্ঞা ছিল, কিন্তু তা সত্বেও তাঁকে আমরা চিনতাম, কারন তাঁর অভিনয় করা অনেক ছবিই আমাদের দেখতে দেওয়া হয়েছিল।
ক্যাসেট চালানো হল। বাঙাল ভাষায় অভাবনীয় সেই উপস্থাপনা শুনতে শুনতে কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের সবার হাসতে হাসতে দম ফেটে যাওয়ার উপক্রম। বলা যেতে পারে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেই আমার প্রথম সত্যিকারের পরিচয়, এবং বাঙাল ভাষার সঙ্গে প্রথম ভালবাসা। তাঁর সেই কৌতুকনক্সা গুলি শুনে শুনেই শিখেছিলাম- বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে থাকতে থাকতে যে অসুখ হয় তার নাম 'হ্যান্ডেলাইটিস'; টেলিফোনে বাঙাল ভাণুর প্রশ্ন -'জিগাই যে...' কেমন ভাবে মাড়োয়ারি ব্যাবসায়ীর কাছে হয়ে যাচ্ছে জগাই, আর সেই জন্য সে অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন করছে -'কৌন জগাই...?' - এই বিভ্রাট প্রায়শঃই ভাইবোনে মিলে অভিনয় করতাম; আরো শিখেছিলাম অনবদ্য কয়েকটি পাঞ্চ- লাইন, যেগুলি এখনও পর্যন্ত মাঝেমধ্যেই সুযোগ পেলে সমঝদার বন্ধুমহলে প্রয়োগ করে থাকি -  'টিনের বাক্সে বারো টাকা ...' 'ভয় কি ? আমিতো আছি...? 'না গো মিনু, আমাগো থার্মোমিটারও নাই, বার্নল ও নাই...'

আসল নাম সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম ১৯২০ সালের ২৭শে অগস্ট, অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা বিক্রমপুরে। পড়াশোনা করেন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি'স হাই স্কুলে এবং পরে জগন্নাথ কলেজে। দেশভাগের আগেই , ১৯৪১ সালে, সাম্যময় কলকাতায় চলে আসেন। তিনি আয়রন অ্যাণ্ড স্টীল কোম্পানি নামের এক  সরকারি অফিসে কাজ শুরু করেন। প্রথম দুই বছর তিনি অশ্বিনী দত্ত রোডে নিজের দিদির বাড়ি থাকলেও, পরে তিনি টালিগঞ্জের চারু অ্যাভিনিউতে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন। জীবনের শেষ দিন (৪ঠা মার্চ, ১৯৮৩ ) অবধি তিনি সেখানেই ছিলেয়ান। তাঁর পরিবার এখনও সেই বাড়িতেই বসবাস করেন।

১৯৪৭ সালে 'জাগরন' ছবির মাধ্যমে সাম্যময়ের অভিনয় জীবনের শুরু। কিন্তু তিনি নিজের নাম পালটে দর্শক সমাজে পরিচিত হলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নামে। ধীরে ধীরে এল 'অভিযোগ' (১৯৪৭), 'মন্ত্রমুগ্ধ' (১৯৪৯), 'বরযাত্রী' (১৯৫১), 'পাশের বাড়ি' (১৯৫২)।

'সাড়ে চুয়াত্তর' মুক্তি পেল ১৯৫৩ সালে। এই ছবি একদিকে যেমন খুঁজে দিল বাংলা চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক জুটিকে, অন্যদিকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সহ আরো একগুচ্ছ চরিত্রাভিনেতাদের সামনে তুলে আনলো। আর বাঙ্গাল ভানুর সেই বিখ্যাত উক্তি -'মাসিমা, মালপো খামু...' তাঁকে করে দিল সবার ঘরের মানুষ, কাছের লোক, দর্শকদের জন্য শুধুমাত্র 'ভানু'।

১৯৪৭ থেক ১৯৮৪, এই সুদীর্ঘ সময়ে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনয় করেছেন  প্রায় তিনশোর কাছাকাছি ছবিতে। কোথাও তিনি নাম ভূমিকায়, কোথাও পার্শ্বচরিত্রে- সর্বত্রই তিনি সমান সাবলীল।  'ওরা থাকে ওধারে' ছবিতে বাঙাল শ্যালক, 'ভ্রান্তিবিলাস' এ যমজ ভৃত্য, 'পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট' এ নায়কের ভূমিকায়, 'মিস প্রিয়ম্বদা'য় মহিলা নার্স, '৮০তে আসিও না' ছবিতে বৃদ্ধ-থেক-তরুন হয়ে যাওয়া নায়ক, 'গল্প হলেও সত্যি' ছবিতে  বাড়ির চেলো বাজানো ছোটকর্তা - এদের কারোকেই কি আমরা ভুলতে পারি? অথবা 'যমালয়ে জীবন্ত মানুষ' (১৯৫৮)? এই ছবিতে সদ্য-বিবাহিতা-এবং-মৃতা স্ত্রীর বিরহে শোকার্ত সিধুকে (ভানু) নানা ঘটনাচক্রে যমদূতেরা যমালয়ে নিয়ে চলে যায়। সেখানে গিয়ে সিধু শুধুমাত্র যমরাজকে তাঁর বজ্র আঁটুনি নিয়ম গুলির মধ্যে কিরকম সব ফস্কা গেরো লুকিয়ে আছে সেটাই বোঝায় না, সে দেবনর্তকী উর্বশীকে 'হাম-হাম-গুড়ি-গুড়ি' নৃত্য ও শিখিয়ে আসে ! এই  অসামান্য চরিত্রটি যেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে মাথায় রেখেই সৃষ্টি হয়েছিল।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্ভবতঃ বাংলার একমাত্র অভিনেতা যাঁর নিজের নাম দিয়ে দুটি ছবি তৈরি হয়েছে, এবং সেখানে তিনি অভিনয় করেছেন - সেদুটি হল- 'ভানু পেল লটারি' (১৯৫৮) এবং 'ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট' (১৯৭১) । এইখানেই ভানু  বন্দ্যোপাধ্যায়, শুধুমাত্র একজন চরিত্রাভিনেতা বা কৌতুকাভিনেতা থেকে নিজেই একটা চরিত্র, এক আইকন হয়ে গেলেন। সে চরিত্র তার বাঙাল ভাষায় কথা বলা, হাঁটা চলা, মুখভঙ্গি, সব মিলিয়ে বাঙালি দর্শক কুলের মনে এমনভাবে নিজের এক বিশেষ ছাপ ফেলে দিল, যে বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে তার ঘোর কাটিয়ে ওঠাই অসম্ভব হয়ে গেল।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বর্নময় যাত্রাপথের সঙ্গী এবং সাফল্যের পুরোমাত্রায় ভাগিদার ছিলেন বাংলা কৌতুক অভিনয়ের উজ্জ্বল নক্ষত্ররা- জহর রায়, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী প্রমুখ। 'ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট' ছবিতে ভানু-জহর জুটির অভিনয় এবং কমিক টাইমিং যে কতদূর সুসংগত, তা এই ছবির সাফল্য এবং অমলিন জনপ্রিয়তা দেখেই বোঝা যায়। শুধুমাত্র এই ছবিটিতেই নয়, ভানু এবং জহর একসাথে অভিনয় করেছেন আরো অনেকগুলি ছবিতে। জহর রায় আর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জুটি বাংলা সিনেমার সফল জুটিগুলির মধ্যে অন্যতম।

লেখার শুরুতেই ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্টি কৌতুকনক্সা গুলির কথা বলেছিলাম। 'সিনেমা বিভ্রাট','লেডি টাইপিস্ট', পুজোর বাজার', 'ইলেকশন','পরিবার পরিকল্পনা', 'সার্বজনীন যমপুজো', 'দুর্গার দুর্গতি', 'কর্তা বনাম গিন্নী', 'নব রামায়ণ'- এহেন বহুবিধ সরস বিষয়বস্তু নিয়ে একগুচ্ছ বিভিন্ন শ্রুতি-কৌতুকনক্সা উপস্থাপনা করেছিলেন তিনি। বেশিরভাগ গুলিই ছিল তাঁর একক উপস্থাপনা। 'সিনেমা বিভ্রাট' এবং 'বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া' এই দুটিতে তাঁর সঙ্গে ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, 'রাজজোটক' এ ছিলেন গীতা দে এবং 'ইলেকশন'-এ ছিলেন চিন্ময় রায়।

শোনা যায় , ব্যক্তিজীবনে এই মানুষটি খুব গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। কিন্তু সেই গম্ভীর মানুষটিই, আরো অনেকের সাথে বাংলা ছবির দর্শকদের প্রাণ খুলে হাসানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ভানু-জহর-নৃপতি-তুলসীর হাত ধরেই বাংলা ছবির স্বর্নযুগের ছবিগুলিতে রোমান্স, ট্র্যাজেডি, মেলোড্রামার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে নির্ভেজাল, অকপট, অনাবিল কমেডি। আজকের প্রেক্ষাপটে, যখন নির্মল,বুদ্ধিদীপ্ত  কমেডির বদলে বাংলা ছবিতে জায়গা করে নিচ্ছে মোটা দাগের রসিকতা এবং ভাঁড়ামো, তখন ভীষণ ভাবে শুনতে ইচ্ছা করে  পরিচিত বাঙাল টানে সেই অতি চেনা কন্ঠস্বর -'...ভয় কি, আমিতো আছি...

(সিনে গিল্ড বালী থেকে প্রকাশিত প্রসংগ চলচ্চিত্র পত্রিকায় প্রকাশিত।
২০১০)