রূপনারায়ণপুর
 
হ্যাঁ, মনে রয়েছে রূপনারায়ণপুর
নামটাই, কারণ গরম এক দুপুরবেলায়
এক্সপ্রেস ট্রেন থেমে গেল যেইখানে
আচম্বিতে, তখন বৈশাখ শেষ প্রায়।

বাষ্প ফুঁসে ওঠে। কেউ গলা খাঁকরায়
কোন যাত্রী নামে না বা ওঠে না বিরল
জনহীন প্ল্যাটফর্মে। দেখলুম শুধু
রূপনারায়ণপুর - নামটা কেবল।

এবং গুলঞ্চ লাল করবী আর ঘাস
ঘেঁটু ফুল আর শুকনো খড়ের ওপর
আকাশের উঁচু উঁচু মেঘেরই মতন
নিস্তব্ধ নিশ্চল আর নিঃসঙ্গ সুন্দর

আর ঠিক সেই মূহুর্তেই এক শ্যামা
গান করে ওঠে- নিকটেই এবং দোহার
গেয়ে ওঠে- যত পাখী ম্রীয়মান সুরে
বর্ধমান আর সাঁওতাল পরগনার।

-বিষ্ণু দে

এই কবিতাটা সেই ছোট্ট রেলস্টেশনটাকে নিয়ে লেখা, যেটার সাথে জড়িয়ে মিলে-মিশে আছে আমার ছোটবেলা। বাবা-মা দুজনেই ছিলেন বাংলা-বিহার সীমান্তের শিল্পশহর হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ এর স্কুলে কর্মরত।  আর হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ সংলগ্ন রেলস্টেশনটির নাম রূপণারায়ণপুর।  আমাদের বাড়ির ঠিকানায় লিখতে হত- টাইপ থ্রি /৮১, হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌, রূপনারায়ণপুর, বর্ধমান।  রূপনারায়ণপুর -  ছোটবেলা থেকে নামটা বড় প্রিয় ছিল - কি সুন্দর নাম, ঠিক যেন ছবির মত । কিন্তু কি দুঃখ - যত বড় বড় স্টীম ইঞ্জিনে টানা ট্রেন, যেগুলিতে চেপে গরমের আর পুজোর ছুটিতে চন্দননগর বেড়াতে যেতাম,  আর ফিরতাম, সেগুলির মধ্যে কোনটাই প্রায় রূপনারায়ণপুরে দাঁড়ায় না। ঘস-ঘস-ঝম-ঝম করতে করতে হুশ করে ছোট্ট স্টেশনটাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে থামে এদিকে সীতারামপুর বা আসানসোল, না হলে ওদিকে চিত্তরঞ্জনে। হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ এর পাশেই চিত্তরঞ্জন, পিঠোপিঠি দুই-ভাইবোনের মত পাশাপাশি দুই শিল্পনগরী।  চিত্তরঞ্জন অনেকটাই বড় স্টেশন। এই পথ দিয়ে যাওয়া প্রায় সব ট্রেনই  এই স্টেশনে থামবে। খোদ ভারতীয় রেল-এর ইঞ্জিন তৈরির কারখানা যে চিত্তরঞ্জন শিল্পনগরীতে। স্বীকার করতে বাধা নেই, মনে মনে একটু দুঃখ হত বইকি ! মাঝেমধ্যেই প্রায় খানিকটা ওরা-আ্মরা গোছের হিংসুটেপনা উঁকি দিত মনের মাঝে। নাহয় রূপনারায়ণপুর হলই একটা ছোট্ট স্টেশন, তাই বলে  কোন বড় ট্রেন-এরই কি এখানে দাঁড়াতে নেই? হয়ত দাঁড়াত এক দুটো, কিন্তু সেইসব ট্রেনগুলিতে আমরা কখনও যাতায়াত করিনি। পরে বড় হয়ে যখন একলা যাওয়া আসা করেছি, তখনও সেই চিত্তরঞ্জন বা আসানসোল স্টেশন ভরসা ! গুনে গেঁথে এক -দু'বার হয়ত ভোরবেলার লোকাল ধরেছি, কিন্তু বিকেলের ট্রেনে রূপনারায়ণপুর স্টেশনে নামিনি কোনদিন। ডাবর মোড়ে পৌঁছানোর একটু আগে , ডানহাতে যে গলিটা মন্দিরের পাশ দিয়ে চলে গেছে, সেটাই যে রূপনারায়ণপুর স্টেশনের দিকে যায় সেটাও জানতাম।  বাবা অথবা মায়ের সাথে ওই পাড়ায় অনেক ছোটবেলায় কোন এক বাড়িতে গেছিলাম, ফেরার সময় বড়দের ছেড়ে একটু অন্যদিকে চলে গেছিলাম বলে সবাই ডেকে ডেকে -"ওইদিকে যাস না, ওইদিকে স্টেশন...হারিয়ে যাবি..." বলে ফিরিয়ে এনেছিলেন। এরকম পাড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়ে রেল স্টেশন কি করে আসে, সেটা জানার কিঞ্চিৎ কৌতূহল থাকলেও, নিজে থেকে আলাদা করে দেখতে যাওয়ার সুযোগ ছিলনা । সব মিলিয়ে, রূপনারায়ণপুর স্টেশনটা আমার কাছে আজও অবধি, রয়ে গেছে প্রায় অচেনা একটা স্টেশন - এক্সপ্রেস ট্রেনে যাতায়াতের সময়ে যে স্টেশন এলে নিজের ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে ক্রমে কম্পার্টমেন্টের দরজার দিকে এগোতে হয়...জানলার কাঁচের পেছনে দেখা যায় বিকেলের  নরম সোনালি রোদ মাখা প্ল্যাটফর্মের একটু ঝলক... শ্যামার গান বা ঘেঁটুফুলের গন্ধ- কোনটারই পরশ পাওয়া যায়না কয়েক মূহুর্তের মধ্যে...

সেই স্টেশন সম্পর্কেই কবি বিষ্ণু দে'র লেখা ওপরের কবিতাটির সন্ধান পাই প্রায় বছর কুড়ি আগে কোন এক দিন, বাড়িতে জমানো পুরনো শারদীয় অর্ঘ্য পড়তে পড়তে। কবিতাটা পড়ে এতই ভাল লেগেছিল যে ডায়রিতে টুকে রেখেছিলাম।  সেই ডায়রির পাতার সন-তারিখ দেখেই আন্দাজ করতে পারছি কবে প্রথম পড়েছিলাম এই কবিতাটি। তখন আমি কলেজে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ছি। আমার  সঠিক মনে নেই, বছর কুড়ি আগে যখন আমি রূপনারায়ণপুরকে নিয়ে লেখা এই কবিতাটা পড়েছিলাম, তার আগেই আমি নিচের এই কবিতাটি পড়েছিলাম কিনাঃ

Adlestrop

Yes. I remember Adlestrop—
The name, because one afternoon
Of heat the express-train drew up there
Unwontedly. It was late June.

The steam hissed. Someone cleared his throat.
No one left and no one came
On the bare platform. What I saw
Was Adlestrop—only the name

And willows, willow-herb, and grass,
And meadowsweet, and haycocks dry,
No whit less still and lonely fair
Than the high cloudlets in the sky.

And for that minute a blackbird sang
Close by, and round him, mistier,
Farther and farther, all the birds
Of Oxfordshire and Gloucestershire.

- এডেলস্ট্রপ নামের এক ছোট্ট, জনহীন স্টেশনকে নিয়ে এই কবিতাটি আজ থেকে ১০১ বছর আগে লিখেছিলেন এডওয়ার্ড টমাস (১৮৭৮ -১৯১৭) - ইংল্যান্ডের বাসিন্দা এই মানুষটি ছিলেন একাধারে পুস্তক সমালোচক, লেখক এবং কবি। ১৯১৪ সালের ২৪শে জুন, ইংল্যান্ডের কট্‌স্‌ওল্ডস্‌ / গ্লস্টারশায়ার অঞ্চলের  ছোট্ট গ্রাম্য স্টেশন এডেলস্ট্রপ-এ, দুপুর বারোটা নাগাদ, ঘস ঘস করে স্টীম ইঞ্জিনে টানা একটি ট্রেন এসে থামে। সেই ট্রেনে যাত্রা করছিলেন এডওয়ার্ড টমাস। বিশেষ কিছু ঘটেনি তারপরে। ট্রেনটির সম্ভবত সেখানে দাঁড়ানোর কথাও ছিল না। ৩৬ বছর বয়সী টমাস সেই  দাঁড়িয়ে থাকা জনহীন স্টেশনে যা দেখেছিলেন, যা শুনেছিলেন, লিখে নিলেন নিজের নোটবইতে। তারপর সেইসব টুকরো ক্ষণ গুলিকে সাজিয়ে লিখে ফেললেন ষোল লাইনের এই কবিতাটি। এটি সম্ভবতঃ টমাসের সবথেকে জনপ্রিয় কবিতা।  টমাস অবশ্য কবিতাটিকে প্রকাশিত হতে দেখে যেতে পারেন নি। তারিখ লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, এই কবিতাটি লেখার কিছুদিনের মধ্যে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এডওয়ার্ড টমাস সেই যুদ্ধে বৃটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে অংশগ্রহণ করেন এবং তিন বছর পরে  ফ্রান্সে যুদ্ধক্ষেত্রেই মৃত্যুবরণ করেন।

ফিরে আসি রূপনারায়ণপুরে। হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ থেকে প্রতিবছর পুজোর সময়ে প্রকাশিত হত শারদীয় অর্ঘ্য নামের পত্রিকাটি। পত্রিকার তরফ থেকে বিভিন্ন সময়ে সুপ্রসিদ্ধ কবি বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২)-কে অনুরোধ করা হয় লেখা দেওয়ার জন্য।  শ্রী সমীর সেন -এর  ' সীমান্ত বাংলার চরিতকথা' বই থেকে জানতে পারছি, বারংবার অনুরোধ করা সত্বেও, বিভিন্ন কারণে কবি বিষ্ণু দে শারদীয় অর্ঘ্যের জন্য কবিতা দিয়ে উঠতে পারছিলেন না। শেষে ১৩৭৯ বঙ্গাব্দে (১৯৭২ ) প্রকাশিত অর্ঘ্যের জন্য তিনি লিখে পাঠান 'রূপনারায়ণপুর' কবিতাটি। সাথে চিঠি দিয়ে সম্পাদককে জানান, বিহারের  ( অধুনা ঝাড়খন্ডের) রিখিয়া থেকে যে দূরপাল্লার ট্রেনে করে তিনি ফিরছিলেন, সিগন্যালের সমস্যার কারণে সেটি রূপনারায়ণপুর স্টেশনে ভরদুপুরে কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায় । আর তার পরে পরেই রূপনারায়ণপুরকে নিয়ে লেখা হয়ে যায় এই মন ছুঁয়ে থাকা কবিতাটি।

ইংরেজি এবং বাংলা কবিতাদুটি পড়লেই বোঝা যায়, কবিতাদুটির মধ্যে বিষয়বস্তুতে এবং শব্দ ও ভাষা প্রয়োগে মিল কতখানি। ধরে নেওয়া যেতে পারে, কবি বিষ্ণু দে, এডওয়ার্ড টমাসের 'এডেলস্ট্রপ' নামক কবিতাটিকে খুবই ভালবেসেছিলেন। হয়ত বা অনুপ্রাণিতও হয়েছিলেন একই ভাবধারার একটা কবিতা লেখার জন্য। আর রিখিয়া থেকে আসা ট্রেনটি কাকতালীয়ভাবে রূপণারায়ণপুর স্টেশনে থেমেছিল বলেই হয়ত কবি পেয়ে গেছিলেন শুধুমাত্র ছোট্ট, খানিক অবহেলিত রূপনারায়ণপুর স্টেশনকে নিয়ে এডেলস্ট্রপের ধাঁচে একটা কবিতা লেখার রসদ, যে কবিতাটা অদ্ভূতভাবে ভারতবর্ষের এক কোণের একটি ছোট্ট জনপদকে মিলিয়ে দিল ইংল্যান্ডের এক ছোট্ট গ্রামের সাথে। !

ফিরে আসি আমার সেই ডায়রির কথায়। আগেই বলেছি, সম্ভবতঃ স্নাতকস্তরে ইংরেজি সাহিত্য পড়ার সময়েই এডওয়ার্ড টমাসের কবিতাটি আমি পড়ি। আর তার আগে বা পরে পড়েছিলাম বিষ্ণূ দে-র লেখা 'রূপনারায়ণপুর'। দুটি কবিতার মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েই ডায়রিতে কবিতাটা লিখে রেখেছিলাম কিনা আজ আর মনে নেই। সময়ের স্রোতে কোন এক ক্ষণে, আরো অনেক পুরনো জিনিষের মতই বর্জিত হয়েছিল সেই ডায়রি, কিন্তু এই কবিতা লেখা পাতাটা ভাঁজ করে রেখে দিয়েছিলাম অন্য কোন ডায়রি বা নোট বই-এর ফাঁকে।  অদ্ভূতভাবে, জীবনের নানা টানা-পোড়েন, নানা চড়াই-উৎরাই-এর মাঝেও, ঘুরে ফিরে, কোন না কোন নোটবইয়ের মলাটের ফাঁকে, দরকারি কাগজের ব্যাগে, বা ফাইলে জায়গা করে নিয়েছিল ছেঁড়া পাতাটা। সম্পূর্ণভাবে ভুলে যাওয়ার পরেও হঠাৎ করে কোন পুরনো ফোল্ডার বা প্যাকিং বাক্সের ভেতর থেকে মাঝেমধ্যেই উঁকি মেরেছে রূপনারায়ণপুর স্টেশন।

সেইভাবেই মাত্র কয়েক মাস আগে আবার কোন এক ভুলে যাওয়া ফাইলের ভেতর থেকে দেখা দিয়েছিল, প্রায় হলুদ হয়ে যাওয়া, ভাঁজ করা ডায়রির পাতার ভেতর থেকে রূপনারায়ণপুর।  তখনই ভাবলাম, এই দুটো কবিতার মধ্যে যে দারুণ মিল, সেটা নিয়ে একটা ছোট লেখা নিজের ব্লগে লিখে ফেলব।  তবে এতদিন পরে, হাজার চেষ্টা করেও, ইংরেজি কবিতাটার বা কবির নাম আর কিছুতেই মনে পড়ছিল না।  কিন্তু অত সহজে কি হাল ছাড়া যায় !ইদানীং কাজের প্রয়োজনে নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করতেই হয়। গুগল এ বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানারকমের প্রশ্ন করে করে শেষ অবধি খুঁজে পেয়ে গেলাম 'এডেলস্ট্রপ'কে, পড়ে নিলাম কবিতা এবং কবি সম্পর্কে, আর  সেই খোঁজাখুঁজি করতে করতেই সাথে পেলাম আরো কিছু তথ্য।  আর সেই  তথ্যগুলি মাথায় আঁকিবুকি কেটে চলল আরো অনেক ভাবনার।

এই মূহুর্তে, ২০১৫ সালে, এডেলস্ট্রপ একটি ছোট্ট, ছিমছাম ছবি মত - ইংরেজিতে যাকে বলে picture postcard style - সেইরকমের গোছানো একটি গ্রাম। ২০১৪ সালের জনগণনা অনুযায়ী, এডেলস্ট্রপের অধুনা বাসিন্দা সংখ্যা মোটে ৮০ জন। আছে বিদেশী রূপকথার বইতে আঁকা ছবির মত, মধুরঙা পাথরের দেওয়াল আর খড়ের চাল ছাওয়া, রংবেরঙের ফুলে সাজানো বাগানে ঘেরা কয়েকটি 'কটেজ', একটি চার্চ, একট পোস্টঅফিস, যেখানে চলে গ্রামের একটি মাত্র দোকান-রেস্তোরাঁ, আর গ্রামের মাঝের একটাই মাত্র বড় রাস্তা, যার দুইপাশে পায়ে চলা নুড়ি বেছানো পথ । আছে  ক্রিকেট খেলার মাঠ, মাছ ধরার ঝিল আর জমায়েতের জন্য ভিলেজ হল। আছে ইতিহাসবিজড়িত একটি গির্জা  এবং  এডেলস্ট্রপ পার্ক। ইতিহাস বলছে,  অষ্টাদশ শতকের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক জেন অস্টেন-এর যাতায়াত ছিল এই গ্রামে। তাঁর 'ম্যান্সফিল্ড পার্ক' উপন্যাসে  এডেলস্ট্রপের বাসিন্দা তাঁর ধনী আত্মীয়দের সামাজিক জীবনযাত্রার নানা ঘটনার ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। তবে এডেলস্ট্রপ গ্রাম হলেও তথাকথিত গরীব গ্রাম নয়। এখানে আছে ঘোড়াদের জন্য এক উন্নতমানের  আস্তাবল এবং প্রশিক্ষণকেন্দ্র। এখানকার ছবির মত বাড়িগুলির   রিয়েল এস্টেট বাজারে আকাশছোঁয়া দাম।  এর কারণ হল, ইংল্যান্ড এবং ওয়েল্‌স্‌-এর বাছাই করা ৩৮টি Areas of Outstanding Natural Beauty (AONB),বা অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যপূর্ণ এলাকার মধ্যে একটি হল কট্‌স্‌ওল্ড অঞ্চল, যেখানেই রয়েছে এডেলস্ট্রপ নামের গ্রামটি।

অবাক ব্যাপার হল, এডেলস্ট্রপে নেই কোন রেল স্টেশন ! - তাহলে এডওয়ার্ড টমাস কিভাবে লিখলেন তাঁর কবিতাটা?  ইতিহাস ঘেঁটে জানা যাচ্ছে,  শিল্প বিপ্লবের পরে, উনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের চতুর্দিকে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে চলে সেখানকার রেলের পরিষেবা ব্যবস্থা। কিন্তু বিংশ শতকের শুরুতে, বিশেষতঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে, সড়কব্যবস্থার উন্নতি ঘটলে, দেখা যায় তার সাথে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে, রেলের এই বিস্তৃত জালিকা অনেকটাই ক্ষতির মুখ দেখছে।  তাই, ব্যবসায়িক ক্ষতি কমানোর তাগিদে, সেই উনিশশো কুড়ির দশক থেকেই ধাপে ধাপে দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে রেলের পরিষেবা কমাতে থাকে বৃটেনের রেল কর্তৃপক্ষ। বন্ধ করে দেওয়া হতে থাকে বিভিন্ন ছোটখাটো স্টেশন এবং গ্রামীন রেল পরিষেবা ব্যবস্থাগুলিকে। আর এইভাবেই, ১৯৬৬ সালে, কোন একদিন, হঠাৎই বন্ধ করে দেওয়া হয় এডেলস্ট্রপ স্টেশনটিকেও।  

গ্রামের অধুনা প্রবীন বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে, স্টেশনটিকে বন্ধ করার আগে রেল কর্তৃপক্ষ সেখানকার মানুষদের একবার জানানোর প্রয়োজনও বোধ করেন নি।  আচমকা একদিন কতগুলি লোক এসে ভেঙে ফেলে রেল স্টেশনের ঘরগুলি, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় পুরনো গুদামঘর। এমনকি , পরে এসে পিটিয়ে সমান করে দিয়ে যায় এডেলস্ট্রপ-এর স্টেশন প্ল্যাটফর্মটিকেও। যেন তারা আগামি পৃথিবীকে জানতেই দিতে চায়না, এখানে কোনদিন একটা রেল স্টেশন ছিল। মূল গ্রামের থেকে মাইলখানেক পশ্চিমে, আজ থেকে বছর পঞ্চাশেক আগে, সেই ছোট্ট স্টেশন চত্বরটি ছিল ছেলেমেয়েদের খেলার জায়গা। তারা সেখানে বাগানের পরিচর্যায় সাহায্য করত। ট্রেন থেকে নামানো গরু-মহিষদের পথ দেখিয়ে গ্রামে নিয়ে যেত, ট্রেনের পা-দানীতে ঝুলতে ঝুলতে পৌঁছে যেত পরের ছোট্ট স্টেশন অবধি...। ভেঙে ফেলার সময়ে, গ্রামের লোকেরা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা এডেলস্ট্রপ নাম লেখা ফলকগুলিকে নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। কর্তৃপক্ষ একটা দিতে রাজি হলেও পরে সেগুলিকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়ে বলেন, ইচ্ছা হলে গ্রামবাসীরা সেখান থেকে নিজেরা নিয়ে আসতে পারেন। আজকের দিনে, সেই ফলকগুলির মধ্যে একটা আটকানো রয়েছে এডেলস্ট্রপের বাস-স্টপের বসার জায়াগায়। সেই বাস স্টপেই একটি ধাতুর পাতে মধ্যে লেখা রয়েছে টমাসের লেখা কবিতাটিও।  এছাড়া , একশো এক বছর আগে ট্রেনে জানলায় বসে , বিষণ্ণ কবি এডওয়ার্ড টমাস যে এডেলস্ট্রপ স্টেশনকে দেখেছিলেন, সেই স্টেশনের আর চিহ্নমাত্রও নেই, যদিও লন্ডনের প্যাডিংটন থেকে হেরেফোর্ড যাওয়ার ট্রেনলাইনটি্‌ যার ওপরে ছিল এডেলস্ট্রপ স্টেশন, এখনো চালু আছে।

 এডেলস্ট্রপ স্টেশনের পরিণতির কথা পড়তে পড়তে মনে হল, এইভাবে কি কোন একদিন হঠাৎ করে ভেঙে ফেলা হতে পারে রূপনারায়ণপুর স্টেশনকেও? কোনও সময় কি আসতে পারে, যখন 'রূপনারায়ণপুর' নামের স্টেশনটার অস্ত্বিত্ব শুধুই থেকে যাবে কবি বিষ্ণু দে'র লেখা একটা ছোট্ট কবিতায়? সেটা হয়ত এই মূহুর্তে এক অসম্ভব, অবাস্তব চিন্তা। শুধুমাত্র রূপনারায়ণপুরেই যথেষ্ট বেশি মানুষ বসবাস করেন, যদিও আমি জানি না এখন রূপনারায়ণপুর স্টেশনে দিনে ক'টা করে ট্রেন দাঁড়ায়। কিন্তু নিজের চোখের সামনে হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ -এর মত একটা সাজানো-গোছানো, গমগমে , প্রাণস্পন্দনে ভরপুর শিল্পশহরকে যেভাবে ধীরে ধীরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে দেখেছি, তাতে মনে মনে ভয় উঁকি দেয় বইকি - ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষেরও একদিন মনে হতে পারে, শুধুশুধু একটা বড় স্টেশনের কয়েক মিনিট আগেই একটা ছোট স্টেশন রেখে লাভ কি? বিশেষ করে যখন পাশের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ নামের শিল্পশহরটাই মৃতপ্রায়!
 
 পাশাপাশি এই কবিতাদুটি  আমাদের এটাই মনে করিয়ে দেয়,  স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি অবশ্যম্ভাবী। তাকে থামানো আমাদের আয়ত্তের বাইরে। যুগে যুগে ঘটে চলা এই ক্রমাগত পালাবদলের আরেক নামই হয়ত প্রগতি, সেটা আমি বা আপনি মানি বা নাই মানি।
 
 এই ভোগবাদের যুগে, কোন জিনিষ একটু পুরনো হলে, একটু ছিঁড়ে কি ফেটে গেলেই , ফেলে দিতে বা বদলে নিতে উৎসাহ দেওয়া হয়। সেই রকম  পুরনো জামা, বা পুরনো ছাতার মতই বাতিলের খাতায় গিয়ে পড়েছে আমার ছোটবেলার হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌। পুরনো ডায়রির পাতাটার মতই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কোয়ার্টারগুলির গায়ের মেটে হলুদ আর ইঁটে রঙ, অযত্নে অবহেলায় শুকিয়ে গেছে বাগানগুলি, ভেঙে পড়েছে পথঘাট। কৃষ্ণচূড়া-রাধাচুড়ার রঙ মাখা, শিরিষ-ঘেঁটু-শিউলির গন্ধ জড়ানো, নীল-সাদা স্কুলবাসের হর্ন -উদয়ন সঙ্ঘের কালিপুজোয় পান্নালালের শ্যামাসঙ্গীত- মে দিবসে সংগ্রামের গানের শব্দে-সুরে ভরা একটুকরো সরস -সবুজ পৃথিবী আজ পড়ে রয়েছে প্রায় প্রাণহীন অবস্থায়। এহেন পরিণতি যে এক বা একাধিক কারণেই ঘটে থাকুক না কেন,  আমার বা আমার মত হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌-এর একদা বা অধুনা বাসিন্দাদের হাতে তার সমাধান নেই। কিন্তু আমি নিশ্চিত, সবার মনের মধ্যেই  জমা থাকছে একরাশ অভিমান আর কষ্ট - ঠিক যেমনটা রয়ে গেছে সুদূর এডেলস্ট্রপের প্রবীন বাসিন্দাদের মনের মধ্যে, তাদের হারিয়ে যাওয়া রেল স্টেশনটার জন্য।
 
 নিজের মনের ভেতরে  রামধনু রঙ আর সোনালি আলোয় আঁকা পরমপ্রিয়  অভিজ্ঞতা আর অনুভূতির ছবিগুলিকে অন্য কেউ যদি ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে ইরেজার দিয়ে ঘষে ঘষে রংচটা আর ময়লা করে দেয়, তাহলে কার আর ভাল লাগতে পারে?
 
 পৃথিবীর দুই প্রান্তে, দুই বিভিন্ন সময়ে লেখা দুই কবির একই ভাবধারার দুটি কবিতা'র মিলটুকু খুঁজে পেয়ে সবার সাথে সেই তথ্যটুকুনিই শুধু ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু  বুঝতে পারিনি, কিভাবে ইতিহাসের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে সামনে চলে আসবে হারিয়ে যাওয়া, না বলা, না শোনা আরো অনেক গল্প। একে অপরের থেকে কয়েকহাজার মাইল দূরে অবস্থিত হয়েও  এডেলস্ট্রপ আর রূপনারায়ণপুর - দুটি অসমবয়সী, একে অপরের অপরিচিত,  নেহাতই ছোটখাটো রেলস্টেশন একই সুতোয় বাঁধা পড়েছে দুই  প্রজন্মের, দুটি ভিন্ন ভাষার, দুই কবির কলমের হাত ধরে।  সেই সুতোয় বাঁধা রয়েছে হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌-রূপনারায়ণপুর, এডেলস্ট্রপ এবং এইরকমই আরো হারিয়ে যাওয়া,  ভুলে যাওয়া, বন্ধ হয়ে যাওয়া, ধ্বংস হয়ে যাওয়া, অগুন্তি জনপদের অসংখ্য মানুষের স্মৃতির ডায়রির হলদেটে হয়ে যাওয়া ছেঁড়া পাতাগুলো।
 
 কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ আশুতোষ সুর

 

ফটোগ্রাফ সৌজন্যঃ
রূপনারায়ণপুরঃ শুভেন্দু চক্রবর্তী, রূপনারায়ণপুর
এডেলস্ট্রপঃ দ্য টেলিগ্রাফ

 

( চিত্তরঞ্জন-রূপনারায়ণপুর থেকে প্রকাশিত উত্তরণ প্রবন্ধ সংকলন ২০১৫ -তে প্রকাশিত )