( ২০১৯ সালের শেষদিকে এমন একটা শক্ত বিষয়ে লেখার আদেশ পেয়েছিলাম, ২০২০ তে প্রকাশিতব্য 'রামায়ণ'- এর ওপর এক সংকলনের জন্য। সম্পাদকমশাই শ্রী আশুতোষ সুর সম্পর্কে মামা (ছোটোবেলায় বাঘমামার সমতুল্য) এবং এক সময়ের শিক্ষক, তাই ফোন করে এমন সব আদেশ-নির্দেশ দিলে সেটা প্রায় ক্লাস অ্যাসাইনমেন্টের সমতুল্য হয়। তাই লকডাউনের প্রথম ঢেউ এবং অন্যান্য বিপর্যয় কাটিয়ে একটা লেখা জমা দিলাম। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ পার করে, সেই সংকলন অবশেষে প্রকাশ পেয়েছে গত বছরের শেষের দিকে। আমাদের প্রান্তিক শিল্পাঞ্চলের একাধিক বরিষ্ঠ, বিদগ্ধ লেখক-লেখিকার সঙ্গে প্রান্তজ প্রকাশনের 'রামায়ণ-কথাঃ একালের চোখে সেকাল' সংকলনে প্রকাশ পেয়েছে রাবণ চরিত্রটিকে নিয়ে লেখা এই ছোট প্রবন্ধটি। লেখাটিকে প্রকাশ করারজন্য 'প্রান্তজ'-কে ধন্যবাদ জানাই। এই সংকলনের মলাটের অপূর্ব সুন্দর কোলাজটি তৈরি করেছেন আমাদের আরেক মামা, শ্রী জয়দেব সুর। এই মলাটের কথা আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয়, তাই ছবিটা সঙ্গে দিলাম।)

পণ্ডিত, অধ্যাপক, গবেষক এ কে রামানুজন ( ১৯২৯-১৯৯৩), ১৯৮৭ সালে ‘Three Hundred Ramayanas: Five Examples and Three Thoughts on Translation’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। বিশ্বের অ্যাকাডেমিক মহলে বহু-আলোচিত এবং চর্চিত এই প্রবন্ধটিতে অধ্যাপক রামানুজন 'রাম'কে ঘিরে উপমহাদেশে পরিচিত এবং প্রচলিত একাধিক মৌখিক এবং লিখিত কাহিনি ও কাব্যের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। ২০০৬-০৭ সাল থেকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের স্নাতক স্তরের পাঠ্যসূচীতে এই প্রবন্ধটি অবশ্যপাঠ্য রূপে অন্তর্গত করা হয়। কিন্তু ২০১১ সালেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল প্রবন্ধটিকে পাঠ্যসূচী থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এই সিদ্ধান্তের পেছনে অবশ্যই চাপ সৃষ্টি করেছিল একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে কৈফিয়ত দেওয়া হয়েছিল, যে প্রবন্ধটি অপ্রয়োজনে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। এর ফলে ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষায় নম্বর পেয়ে পাশ করার মত উত্তর দেওয়ার জন্য প্রবন্ধটি বিশ্লেষণ করার পরিবর্তে একাধিক অন্যান্য লেখা পড়তে হচ্ছে, যার ফলে তারা খেই হারাচ্ছে এবং তাদের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না।

আসল কারণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাখ্যা যাই হোক না কেন, এক বিশেষ ছাত্র সংসদের 'ধার্মিক অনুভূতি'তে আঘাত লাগার ফলে, এই মনোগ্রাহী, তথ্যপূর্ণ প্রবন্ধটি আরও বহু মানুষের নজরে আসে, এর পঠন-পাঠন বৃদ্ধি পায় এবং প্রবন্ধটি পাবলিক ডোমেনে পড়াও যায়। এই বহু আলোচিত এবং বিতর্কিত প্রবন্ধটি The Collected Essays of A.K. Ramanujan (New Delhi: Oxford University Press, 1999, 2004) বইটিতে সংকলিত রয়েছে। তবে ইদানীং সম্ভবতঃ ভারতবর্ষে বইটির মুদ্রিত সংস্করন নতুনভাবে আর কিনতে পাওয়া যায় না।

এই আলোচনার মূল বিষয়বস্তুতে যাওয়ার শুরুতেই এই নিবন্ধের অবতারনা একটাই কারণে করলাম। বহুমাত্রিকতায় বিশ্বাসী ভারতবর্ষে এই মূহুর্তে জীবনের সর্বস্তরে একমাত্রিকতা প্রতিষ্ঠা করার রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা অব্যাহত। যেকোনো বিষয়ের বহুমাত্রিক আলোচনাই রাষ্ট্রের নাপসন্দ। বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক ভাবধারার ওমে ভরা নকশি কাঁথার বদলে একরঙা কুটকুটে কম্বলে ঢেকে যাচ্ছে দেশ। এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, রাবণকে আলোচনার জন্য একটি কোনো বহু প্রচারিত এবং পঠিত 'রামায়ণ'- পাঠ এবং বিশ্লেষণ করলে নিজস্ব সামাজিক এবং বৌদ্ধিক নিরাপত্তা রক্ষিত হবে সন্দেহ নেই। তবুও আধুনিক ভারতে উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় যেহেতু একাধিক সমান্তরাল তথ্যভান্ডার এখনোও নাগালের মধ্যে রয়েছে এবং সেগুলিকে নিষিদ্ধ করা হয়নি, তাই একের বদলে একাধিক সূত্রের উল্লেখ রাখাই শ্রেয় মনে করছি।

সাধারণ ভাবে আমাদের জনমানসে এমনই এক ধারণা প্রচলিত আছে যে 'রামায়ণ' - সেটা যে ভাষাতেই এবং যে সময়েই প্রকাশিত হয়ে থাকুক না কেন, সেটি হল বাল্মিকী রচিত রামায়ণের সরাসরি অনুবাদ। রামায়ণের কাহিনির কোনো দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণ থাকা সম্ভব নয়। অধ্যাপক রামানুজন এই প্রবন্ধে বাল্মিকী রচিত সংস্কৃত রামায়ণ, কম্বন রচিত তামিল রামায়ণ এবং থাই ভাষায় রচিত একটি রামায়ণের তুলনামূলক আলোচনা করেন এবং দেখান কীভাবে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে, 'রামায়ণ'-এর একাধিক রূপ দেখতে পাওয়া যায়। সঙ্গে রয়েছে জৈন রামায়ণ সহ অপেক্ষাকৃত অপরিচিত বিভিন্ন স্থানীয় রামায়ণের আলোচনাও। কাহিনির মূল রেখাচিত্র এক থাকলেও, চরিত্রগুলি বদলে যায়, বা ঘটনাপরম্পরা বদলে যায়। এবং এইভাবে, এই উপমহাদেশেই , বিভিন্ন ভাষায় এবং শুধুমাত্র লিখিত কাহিনি হিসেবেই নয়, সঙ্গে নৃত্যনাট্য , সংগীত, পুতুল -নাচ , নাটক, যাত্রা ইত্যাদি রূপে নির্মিত হয়েছে অজস্র-অগুন্তি রামায়ণ। আর প্রতিটি নতুন পরিবেশনায় আমরা পাই একজন করে নতুন রাম, সীতা, লক্ষ্মণ বা রাবণকে। স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের পরিচিত 'খলনায়ক' রাবণ চরিত্রকেও নানাভাবে পাঠ করার সুযোগ পাওয়া যায় । এই সংক্ষিপ্ত আলোচনাতে কোনো এক বিশেষ 'রামকথা' বা 'রামায়ণ'-এর ভরসায় না থেকে, চেষ্টা করেছি একাধিক সূত্র থেকে রাবণ চরিত্রটিকে চেনার - যে চরিত্রটি শুধুমাত্র 'খারাপ' চরিত্র নয়, বা হতে পারে না, বরং যে চরিত্র নির্মিত অনেকগুলি ধূসর স্তরের সমাহারে।

রাবণ। লংকাদ্বীপের প্রবল পরাক্রমী শাসক, দশ মুন্ড ও কুড়িটি হাত তাঁর। ব্রহ্মার পৌত্র ঋষি বিশ্রবা ও রাক্ষসী নিকষা (কৈকসী)-এর সন্তান তিনি। যুদ্ধবিদ্যায় তিনি পারদর্শী, একই সঙ্গে তিনি শাস্ত্রজ্ঞ এবং বেদজ্ঞ। শিবের পরম ভক্ত তিনি। মোক্ষ লাভের আশায় শিবকে সন্তুষ্ট করার জন্য 'শিব তান্ডব স্তোত্র' তিনিই রচনা ও সুরারোপ করেছিলেন। চিকিৎসাশাস্ত্র এবং আয়ুর্বেদেরও অনেকখানি তাঁর অধীত । আয়ুর্বেদশাস্ত্রের বেশ কয়েকটি পাঠ্য তিনিই রচনা করেন। তিনি চৌষট্টি কলায় নিপুণ, সংগীতজ্ঞ এবং জ্যোতিষবিদ্যায় পারদর্শী । তাঁর রাজ্য ধন-ধান্যে পূর্ণ, তাই স্বর্ণলংকা নামে পরিচিত। অসংখ্য নারী তাঁর অংকশায়িনী, সবল সুযোগ্য সন্তানদের পিতা তিনি।

রামায়ণ-এর নায়ক রামচন্দ্রের মুখ্য দ্বিষৎ তিনি। লক্ষ্মণ কর্তৃক নিজের বোন শূর্পনখার অবমাননা এবং শারিরীক ক্ষতির প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে, রামচন্দ্রের স্ত্রী সীতাকে তিনি কপট ছলের সাহায্যে হরণ করে নিয়ে যান। তবে সীতার সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট ও হয়েছিলেন তিনি । নিজের বোনের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই হোক বা সীতার রূপে মুগ্ধ হয়েই হোক, সীতাকে অপহরণ করা রাবণের গর্হিত অপরাধ ছিল। এই অপরাধ একভাবে পৌরুষের আস্ফালন, কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার, রাবণ সীতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁর ওপর শারিরীকভাবে বলপ্রয়োগ করেন নি। এই সিদ্ধান্তের কারণ রূপে অবশ্য একটি অভিশাপের কাহিনি ঘুরে ফিরে এসেছে। বানরসেনাদের সহায়তায়, সমুদ্রের ওপর সেতু নির্মাণ করে রাম এবং লক্ষ্মণ লংকায় গিয়ে পৌঁছান এবং ভয়ানক যুদ্ধ করে রাবণকে প্রায় সপরিবারে নিহত করে জয় লাভ করেন আর সীতাকে ফিরিয়ে আনেন। মৃত্যুশয্যায় দশানন নিজের কাজের জন্য রামের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

রাম-লক্ষ্মণের হাতে রাবণের পরাজয় — এই ঘটনাকে মনে রেখে দশেরার দিন রাবণের কুশপুত্তলিকা দহন উত্তর ভারতের কিছু অংশে এক জনপ্রিয় বার্ষিক উদযাপন। একাধিক মূলধারার হিন্দি ছায়াছবিতেও দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন প্রতিষ্ঠায় এই একই ছবির প্রতিফলন দেখা যায়। রাবণ-দহন অনুষ্ঠানের ছবি ও খবর প্রতিবছরে দশেরার সন্ধ্যায় দেখা দেয় প্রাইম-টাইম টেলিভিশনে।

কামুক, ধর্ষকামী রাবণ, ক্ষমতা বিস্তারের উদ্দেশ্যে ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাওয়া রাবণ, নিজের জ্যেষ্ঠ্য ভ্রাতা কুবেরকে অপসরণ করে তাঁর রাজত্ব দখল করে নেওয়া রাবণের এই পরিণতিই তো হওয়ার কথা। এর পরে আর রাবণকে নিয়ে কীই বা আলোচনা করার থাকতে পারে? এমন কিছু আলাদা, যা তাঁকে গঠনমূলক আলোচনার বিষয়বস্তু বানিয়ে তুলতে পারে?

রাবণকে নিয়ে আলোচনা এখানেই থেমে যেতে পারে , বিশেষতঃ তুলসীদাস বিরচিত এবং ক্রমশঃ অতি-সরলীকৃত, পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিকোণে নির্মিত 'রামায়ণ'-এ বিশ্বাসী ভারতীয় জনমানসে। এই বিশ্বাস আরও বেশি ডালপালা ছড়িয়েছে আশির দশকে, যখন বেশ কয়েকবছর, রবিবারের সকালে ধূপ-দীপ জ্বেলে 'ভারতীয়'রা দূরদর্শনে রামানন্দ সাগরের 'রামায়ণ' দেখেছেন। এই ধারাবাহিক আমাদের জানিয়েছে এবং বুঝিয়েছে, রাবণ নিতান্তই খারাপ এক চরিত্র, রামের হাতে মৃত্যু বরণেই তার মুক্তি। পাশ্চাত্য দর্শনের ‘good-evil dichotomy' মেনে সহজ দ্বিবিভাজনে ভারতীয় জীবনদর্শন স্থিত না হলেও, এই ধরনের অনুষ্ঠানের নিয়মিত প্রচার তেমনই সহজ তত্বে সমস্ত সমস্যার সমাধানে আমাদের অভ্যস্ত করে দিতে পারে এবং দিয়ে থাকে। কিন্তু 'ভারতীয়' - এই শব্দটি যেহেতু আসলে বহুমুখী রুদ্রাক্ষ কিংবা জটিল পলকাটা হীরের মত, তাই রাম, রাবণ বা রামায়ণ নিয়ে সমান্তরাল ভাবনাস্রোত গুলির সঙ্গে পরিচিত হতে আমাদের বাধা নেই। বরং বিবিধ ধারার কাহিনিগুলির মিশেলেই একমাত্রিকতা ছাড়িয়ে চরিত্রটি বহুমাত্রিক, স্বাভাবিক এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

সারা ভারতে অন্তত ছয়টি মন্দির আছে, যেখানে রাবণের পুজো করা হয়। এর মধ্যে সবথেকে পরিচিত হল গ্রেটার নয়ডা অঞ্চলে বিসরাখ গ্রামের রাবণ মন্দির। মনে করা হয়, বিসরাখ গ্রামের নামকরণ হয়েছে রাবণের পিতা বিশ্রবা মুনির নামে। পুরাণ মতে, বিশ্রবা মুনি এইখানে শিবের উপাসনা করে রাবণকে পুত্ররূপে লাভ করেছিলেন। বিসরাখের বাসিন্দারা তাই নিজেদের গ্রামকে রাবণের জন্মস্থান মনে করেন। এই মন্দিরটি বিভিন্ন সময়ে বিবিধ 'ধর্মীয়' আক্রমণের মুখে পড়েছে, তবুও এই মন্দিরে রাবণের পুজো অব্যাহত রয়েছে। উল্লেখযোগ্য, বিসরাখ থেকে অযোধ্যার দূরত্ব মোটামুটি সাড়ে নয় ঘন্টার যাত্রাপথ। বিসরাখের বাসিন্দারা রাবণ দহনে বিশ্বাসী না হলেও, এবং নিজেরা রামের উপাসক না হলেও, ২০১৬ সালে বাধ্য হয়েছেন তাঁদের গ্রামের মন্দিরে রাম-লক্ষ্মণ-সীতার মূর্তি স্থাপন করতে। ২০২০ সালে অযোধ্যায় নির্মিতব্য রাম মন্দিরের ভূমিপূজার জন্য বিসরাখ ধামের মাটি ও জল পাঠাতেও ভোলেন নি।

দ্বিতীয় মন্দিরটি - দশানন রাবণ মন্দির - রয়েছে কানপুরের শিবালা অঞ্চলে। এই মন্দিরটি বছরে একবার দশেরার দিনে দরজা খোলে, যেদিন রাবণের ভক্তেরা একত্র হন তাঁকে পুজো দেওয়ার জন্য।

হিমাচল প্রদেশের কাংড়ার মানুষেরা বিশ্বাস করেন রাবণ শিবের একজন পরম উপাসক, এবং সেই কারণে তাঁরা রাবণ দহনে শামিল হন না। অন্ধ্র প্রদেশের কাকিনাডা রাবণ মন্দিরের ভক্তদেরও একই বিশ্বাস। কর্ণাটকের কোলারের মানুষেরা ফসল কাটার সময়ে রাবণের উপাসনা করেন।

একদমই আলাদাভাবে, রাবণের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্কের সূত্র নিয়ে গর্বিত রয়েছেন আরও বিবিধ জনগোষ্ঠীর মানুষ। এঁদের সঙ্গে রাবণের সম্পর্ক ঠিক ভক্ত ও ভগবানের নয়। যেমন মধ্য প্রদেশের মন্দসোরের মানুষেরা মনে করেন, রাবণের স্ত্রী মন্দোদরীর বাপের বাড়ি ছিল মন্দসোর। তাই সম্পর্কে রাবণ তঁদের জামাই। এই শহরের মাঝে অবস্থিত পঁয়ত্রিশ ফুট উঁচু রাবণ মূর্তির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে তাই শহরের মহিলারা মাথায় ঘোমটা তুলে তাঁদের 'জামাই'কে সম্মান জানান। রাজস্থানের যোধপুরের মুদ্‌গিল ব্রাহ্মণেরা নিজেদের রাবণের উত্তরসুরী মনে করেন। মন্দসোরের মানুষেরা এবং এই মুদ্‌গিল ব্রাহ্মণেরা দশেরার সময়ে রাবণের শ্রাদ্ধ ও পিন্ডদান করেন। আবার মধ্যপ্রদেশের বিদিশা অঞ্চলে একটি পুরো গ্রাম পরিচিত 'রাবণগ্রাম' নামে। এখানকার কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণেরা এবং অন্যান্য বহু জাতের মানুষেরা নিজেদের রাবণের বংশধর রূপে পরিচয় দেন এবং নিয়মিত এই গ্রামের মন্দিরের এক দশ ফুট লম্বা শায়িত রাবণের মূর্তিকে পুজো করেন। গ্রামে বিয়ে হলে প্রথম নিমন্ত্রণপত্রটি যায় এই রাবণ মন্দিরে। এখানকার মানুষেরা মনে করেন, রাবণ ছিলেন একাধারে একজন মহাজ্ঞানী এবং সাহসী যোদ্ধা। অন্যান্য দেবদেবীদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেই এই সমস্ত জায়গার মানুষেরা দশেরার দিনে রাবণ দহনে অংশগ্রহণ করেন না।

রাবণকে নিজেদের পূর্বপুরুষ রূপে দাবী করেন মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে থাকা গোন্দ আদিবাসী জনজাতির মানুষেরা। তবে এক্ষেত্রে যেটা লক্ষণীয় সেটা এই যে, মাতৃতান্ত্রিক গোন্দরা মনে করেন রাবনের মাতা কৈকেসী অনার্যা ছিলেন। সেই জন্য রাবণ তাঁদের কাছে পূজনীয় এবং পূর্বজ রূপে স্বীকৃত। বিশ্রবা বা পুলস্ত্যর 'ব্রাহ্মণ' পরিচয় তাঁদের কাছে জরুরী নয়।

গোন্দ সমাজে হোলির দিনে রাবণের পুত্র মেঘনাদের পুজো করা হয়। বর্ষার আগমনে মন্দোদরী মাতা রূপে পূজিত হন। গোন্দ প্রাজ্ঞদের মতে, মূল বাল্মিকী রামায়ণে রাবণ ছিলেন ভালোয়-মন্দয়ে মেশানো এক চরিত্র। কিন্তু পরবর্তীকালে রামায়ণের একাধিক রদবদলের এবং নতুন অধ্যায় সংযোগের ফলে রাবণকে শুধুই এক খারাপ চরিত্র রূপে নির্মাণ করা হয়। প্রকৃতিপূজায় বিশ্বাসী গোন্দ জনজাতির নিজস্ব রামায়ণ আমাদের পরিচিত রামায়ণের ধারণাকে পুরোপুরি ওলটপালট করে দেয়। গোন্দ ভাষাবিদ ,পন্ডিত এবং লেখক শ্রী মোতিরাবণ কংগালির মতে, রাবণ ছিলেন মধ্যভারতের এক গোষ্ঠীপ্রধান বা রাজা, এবং গোন্দ জনজাতির ধর্মগুরু, যাঁকে অন্যায় যুদ্ধে হারিয়ে আর্যরা নিজেদের সুবিধামত এক বিকৃত ইতিহাসের প্রচলন করেছিল। গোন্দী ভাষায় 'লংকা' মানে হল পাহাড়ি এলাকা। গোন্দ 'রামায়নী' অনুযায়ী, মধ্যপ্রদেশের অমরকন্টক অঞ্চলেই ছিল রাবণের রাজধানী ; সুদূর দক্ষিণের লংকাদ্বীপের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।

গত কয়েক দশকে , উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রাখার স্বার্থেই , গোন্দ জনজাতির মানুষেরা আরো বেশি করে রাবণকে নিজেদের পূর্বসুরী এবং নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতীক রূপে প্রতিষ্ঠিত করছেন। দশেরার সময়ে মহারাষ্ট্র,মধ্যপ্রদেশ এবং অন্যান্য রাজ্যে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা গোন্দ জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে রাবণ পুজো, এবং পুজোকে ঘিরে মেলা, র‍্যালি ইত্যাদি ক্রমশঃ জনপ্রিয় হচ্ছে। এঁরা নিজেদের সগর্বে 'রাবণবংশী' বলে পরিচয় দিচ্ছেন, নিজেদের নামের মধ্যে 'রাম' শব্দটি থাকলে সেটিকে পাল্টে 'রাবণ' করে নিচ্ছেন। উচ্চপদস্থ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী রূপে কাজে যোগ দেওয়ার অনেক আগেই, মোতিরাবণ কংগালি রাবণ দহনের প্রতিবাদে নিজের নাম মোতিরাম থেকে পাল্টে মোতিরাবণ করে নিয়েছিলেন। এঁদের সবার মতে, দশেরার সময়ে 'রাবণ দহন' উত্তর ভারতের একটি অপেক্ষাকৃত নতুন উদযাপন, যা নাগপুরে শুরু হয়েছিল ১৮৩৮ সাল নাগাদ। কিন্তু তার বহু যুগ আগে থেকেই গোন্দ জনজাতি রাবণের উপাসনা করেন।

'রামায়ণ' ভারতবর্ষের প্রথম মহাকাব্য এবং কালক্রমে একটি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ রূপে পরিচিত। তবে প্রায় খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত এই মহাকাব্যটিকে যুগে যুগে একাধিক পাঠান্তর এবং সংস্করণের মধ্য দিয়েই শুধু যায়নি, বৌদ্ধ, জৈন এবং প্রকৃতি উপাসক বিভিন্ন ধর্মের জনজাতি নিজেদের মত করে রামায়ণ রচনা করেছেন, রামায়ণের কাহিনিকে নতুন সুতোয় গেঁথেছেন। আবার মেয়েদের কলমে, এবং বিভিন্ন পেশায় থাকা মানুষদের তৈরি গানে রামায়ণের কাহিনি দেখা দিয়েছে একেবারেই অন্যরূপে। তাই রামায়ণ কে শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বলে চিহ্নিত করতে চাইলে, বা এই প্রাচীন মহাকাব্যের ওপরে শুধুমাত্র হিন্দুদের অধিকার আছে- এমন দাবী নিয়ে দাঁড়ালে বোধকরি মহাকাব্যটিকে এবং যুগযুগান্ত ধরে এই সাহিত্যকর্মটিকে উত্তরপ্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া অগুন্তি কবি-শিল্পীদের অবমাননা করা হবে। আর ঠিক এই কারণেই, রাবণকেও সম্পূর্ণ কালিমালিপ্ত একমাত্রিক খলনায়ক রূপে না দেখে, দোষে গুণে ভরা এক চরিত্র রূপে পাঠ করার প্রচেষ্টা আমাদের সামগ্রিক ইতিহাসচেতনার দুয়েকটি বন্ধ দরজার কড়ায় নাড়া দিতে পারে।

কোলাজঃ জয়দেব সুর
কোলাজ সৌজন্যঃ 'রামায়ণ-কথাঃ একালের চোখে সেকাল', প্রান্তজ প্রকাশন