হাওড়া -ব্যান্ডেল মেইন লাইনে মানকুন্ডুতে আমাদের একটা বাড়ি ছিল। আজ থেকে প্রায় বছর তিরিশেক আগে, সেখানে থাকতেন আমার ঠাকুরদা-ঠাকুমা ( আমাদের কাছে দাদু-দিদু), আমার দুই কাকা, তিন পিসি। আরো থাকতেন আমাদের ছোটদাদু-ছোটদিদু ( আমার বাবার কাকা-কাকিমা) আর তাঁদের ছেলে আর মেয়ে, আমাদের মণিকাকু আর মণিপিসি। থাকতেন আমার আরেক কাকা-কাকিমা, তাঁদের দুই ছেলে নিয়ে। মোট কথা, প্রচুর লোক । কয়েক বছরের ব্যাবধানে পিসি-কাকুদের বিয়েও হয়ে গেল, ফলে বাড়িতে জনসংখ্যা কমে যাওয়া এবং বেড়ে যাওয়া দুই-ই হল। এই পোস্ট অবশ্য সেই বাড়ির লোকজনদের নিয়ে নয়।সেই বাড়ি সংলগ্ন একটা বাগান ছিল, সেই বাগান নিয়ে।আন্দাজমত বিঘেখানেক জমির সেই বাগানটা ছিল ছোট্ট 'আমি'র কাছে এক বিশাল রহস্যময়, কিন্তু ভাললাগার , ভালবাসার জায়গা। সারা বছর মুখিয়ে থাকতাম গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটির জন্য - ছুটি পড়লেই ব্যাগ বাক্স গুছিয়ে দিন পনেরোর জন্য চলে আসা হত মানকুন্ডু। আমরা বলতাম চন্দননগরের বাড়ি; যদিও ট্রেন থেকে নামতাম মানকুন্ডু স্টেশনে। বাড়ির শেষে খিড়কির দরজা দিয়ে সেই বাগানে ঢোকার পথ। শ্যাওলাধরা, আধভাঙ্গা ইঁটের দুই ধাপ পেরিয়ে, বাঁ হাতে একইরকম শ্যাওলাধরা ইঁটবাঁধানো কলতলা। সেইখানে মাঝে মাঝেই দেওয়ালের গায়ে সেঁটে থাকত বড় বড় শামুক। দেখেই ভয়ে একলাফে তফাত! তার পাশেই একটা গোল বাঁধানো চৌবাচ্চা। সেখানে অনেকদিন অবধি রঙিন মাছ রাখা থাকত। একটু এগিয়ে ডান দিকে একটা লাল পঞ্চমুখী জবাফুলের গাছ। সারা বছর রাশি রাশি ফুল দিয়েও গাছটা ক্ষান্ত হত না। আমাদের বাড়ির আর আশেপাশের দুয়েকটা বাড়ির নিয়মিত পুজোর ফুলের যোগানদার ছিল এই গাছ।জবাগাছের পাশ দিয়ে ডান দিকের পাঁচিল অবধি একটা সরু পরিষ্কার পথ। তার পাশ দিয়ে দিয়ে লাগানো সারে সারে পাতাবাহার। এই সুন্দর পথের শেষে অবশ্য একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার ছিল। তিন ধাপ পেছল সিঁড়ি বেয়ে উঠে একটা চৌকোনা ঘর। আগেকার দিনে অনেক বাড়িতেই থাকত। প্রাতকৃত্য সারার জায়গা। সেটাকে বাড়ির পুরুষেরাই বেশিরভাগ ব্যবহার করতেন। আমরা ভয়ে ধারকাছ ঘেঁষতাম না। একটু বড় হওয়ার পরে অবশ্য আমার ধারণা জন্মেছিল যে আমার কাকুরা ওখানে যান লুকিয়ে সিগারেট খাওয়ার জন্য।কলতলা থেকে সরাসরি একটা পথ চলে গেছে বাগানের শেষ অবধি। তার বাঁহাতে প্রথমে খানিকটা বাঁধানো জায়গা ছিল, সেটা খুব সম্ভবত ছিল সোকপিট। তার পরেই একটা লম্বা বড়সড় রংবাহারি পাতাবাহার। এই পাতাবাহারের তলা দিয়ে , এবং এই সোজা পথের অন্যপাশেও ছিল সন্ধ্যামালতীর ঝোপ। ম্যাজেন্টা, হলুদ আর সাদা। মিলেমিশে। সন্ধ্যামালতীর গন্ধ খুব হালকা আর মিষ্টি। এই ফুল ফোটে বিকেলের রোদ পড়ে গেলে। সারা রাত ফুটে থাকে। সকাল বেলায় শুকিয়ে যায়। পথের বাঁপাশে তিন চার খানা আমগাছ। আর ডান দিকে একটা জামরুল গাছ। আমগাছগুলি পেরিয়ে গিয়ে বাঁহাতে একটা ফলসা গাছ। আর ডান দিকে পাঁচিলের গা ঘেঁষে একটা কাঁঠাল গাছ। এইসব গাছের তলায় ইতস্তত ছড়ানো কচুবন।আমাদের গন্ডি ফলসা গাছ অবধি। তার পরে বেশিরভাগটাই জঙ্গলের মত, যার মাঝখান থেকে, পাঁচিলের আগে, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ -ছ'খানা নারকেল গাছ। আরো গাছ নিশ্চয় ছিল, কিন্তু অত ছোটবেলার স্মৃতি সব ভুলতে বসেছি। ওহ হ্যাঁ, ফলসা গাছের পাশেই ছিল একটা কল্‌কে ফুলের গাছ। আর ছিল একটা বেল গাছ। আশেপাশেই কোথাও একটা সাদা পাঁচপাপড়িওয়ালা টগরের গাছ ছিল। বেশ কয়েকটা কলাগাছ ছিল।এই বাগানের সাথে জড়িয়ে আছে নানারকমের স্মৃতি। দুপুরবেলা বাগানটাকে খুব রহস্যময় লাগত। কুব-কুব করে পাখি ডাকত। আমি দোতলার কোণের ঘরের জানালা থেকে বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। গ্রীষ্মকালে গাছ ভরে হত আম, জামরুল, ফলসা আর কাঁঠাল। পাড়ার ছেলেরা খেলতে বেরিয়ে পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে এসে জামরুল পেড়ে নিয়ে যেত। খুব রাগ হত তখন। বাবা-কাকারা আমগাছে উঠে আম পাড়তেন। মাঝেমধ্যে আম নিজে থেকে পড়ে গেলে , পাশের বাড়ির ছেলে হয়ত পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে এসে নিয়ে চলে যেত। তখন আমি আর মণিপিসি গিয়ে বড়দের নালিশ করতাম। মণিপিসি আমার থেকে মাত্র কয়েক বছরের বড়, তাই সে ছিল আমার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে ফলসাতলা থেকে পাকা ফলসা কুড়িয়ে খেতাম। সত্যি বলতে কি, কলকাতার রাস্তায় আজকাল প্রচন্ড বেশি দামে ফলসা আর জামরুল বিক্রি হতে দেখলে আমার অদ্ভূত রাগ আর কষ্ট হয়। ফলসা গাছের পরে আমাদের যাওয়া বারণ ছিল মূলতঃ জোঁকের ভয়ে। আমার দাদুকে দেখেছি সেই প্রৌঢ় বয়সে নারকেল গাছে উঠে নারকেল পাড়তে। কিন্তু সেই জঙ্গল থেকে বেরোলেই দেখা যেত, তাঁর পায়ে আটকে আছে জোঁক। সেই জোঁক ছাড়ানো হত নুন ছড়িয়ে। এইসব দেখেশুনে আর ওদিকে যাওয়ার চেষ্টা কোনদিন করিনি। একদিন দুপুরবেলা দেখেছিলাম, আমার এক কাকা কিরকম ভাবে শুকনো নারকেলের পাতা ছাড়িয়ে ঝাঁটা বানাচ্ছেন। খুব অবাক হয়ে গেছিলাম দেখে।এই বাগানটা ছিল আমার আর মণিপিসির রান্নাবাটি খেলার বাজার। প্রায় সুপারমার্কেট বলা চলে। সন্ধ্যামালতীর শুকিয়ে যাওয়া ফুল এনে জলে চটকে চটকে তৈরি হচ্ছে লাল সরবত। এই গাছেই ধরে দুই রকমের ফল- কালো আর সাদা। সেই কালো ফল হল পান্তুয়া/ কালোজাম, আর সাদা ফল হল রসগোল্লা। সন্ধ্যামালতীর নরম পাতা ওষুধের বোতলের ছিপি দিয়ে গোল গোল করে কেটে লুচি। কচুর নরম পাতাকে সোজা উলটো ভাঁজ করে, ব্লেড দিয়ে সরু সরু করে কেটে ফেললেই হয়ে গেল কুঁচকে থাকা চাউমিন। বড় বড় পাতাবাহারের পাতা হল পাকা মাছ। আরো সব নানারকমের রান্নাবান্না বাজার হাটের সরঞ্জাম যোগাড় হত এই বাগান থেকেই।১৯৮৬ সালে আমার দাদু মারা যাওয়ার পর, নানাকারণে এই বাড়িটা বিক্রি হয়ে যায়। আমার ছোটবেলার স্মৃতি জড়ানো সেই বাগানের সাথে আমার যোগাযোগ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।(২)আমার বাবা ছিলেন হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীর স্কুলের শিক্ষক। আমার ছোটবেলা কেটেছে এই শিল্পনগরীর যে ছোট্ট দু-কামরার কোয়ার্টারে, তাকে ঘিরে বাবা করেছিলেন এক মনোলোভা বাগান। কি গাছ না ছিল সেখানে ! কোয়ার্টারের দুই ঘরের তিনটে জানালা দিয়ে লতিয়ে ওঠানো যুঁই, লাল রঙ্গন আর মাধবীলতা। বাগানের মাঝখানে ছোট্ট বরফি আকৃতির লন, চারিপাশে ইঁট দিয়ে ঘেরা। লনে ঢোকার পথে দুই পাশে দুটি এরিকা পাম। লনের চারিদিক ঘিরে গোলাপের গাছ। বাগানে ঢোকার পথে বেল ফুলের গাছের সারি, তার পাশে গন্ধরাজ। লনের মাথে ঘেঁষে সারি দিয়ে গ্লোব লিলি ফুটত বর্ষাকালে। ছিল চার রকমের বোগেন ভিলিয়া - ম্যাজেন্টা রঙের থোকা এবং তিন পাপড়িফুল, এছাড়া কমলা ও সাদা। আরো ছিল দুটো শিউলি গাছ, তার মধ্যে একটাতে প্রায় সারা বছর ফুল ফুটত। কাঠগোলাপ, টগর, কাঞ্চন, রঙ্গন, লিলি, কামিনী, নানারকমের পাতাবাহার, দেবদারুও ছিল। বর্ষাকালে গন্ধরাজ গাছে এত ফুল ফুটত, যে গাছটার আর পাতা দেখা যেত না । আরো ছিল মরসুমি বেলি ফুল, দোপাটি আর গাঁদা।পাশের দিকে এবং পেছন দিকে ছিল বেনারসী লাল পেয়ারার গাছ, জাম, কাঁঠাল, টোপাকুল, আর লেবু গাছ। আমরা যে বছর কোয়ার্টার ছেড়ে চলে আসি, জামগাছটা সেই বছরই প্রথম ঢেলে ফল দিয়েছিল। তার আগে কোন দিন ওই গাছে ফল হয়নি। তবে পেয়ারা আর কুল হত অফুরন্ত। পেয়ারা গাছে উঠত বাবার কাছে পড়তে আসা ছাত্ররা, আর মাটিতে পড়ে থাকা কুলের লোভে ভীড় জমাত পাশের প্রাইমারি স্কুলের ছেলেমেয়েরা।এই বাগানে বোগেনভিলিয়ার ঝাড়ের নিচে খেলনা বাসনপত্র নিয়ে বন্ধুদের সাথে ছুটির সকালে রান্নাবাটি খেলেছি বহুদিন। একবার শীতকালে এই বাগানে লুচি-মাংস রান্না করে আমাদের বাতসরিক পিকনিকও হয়েছিল।এই কোয়ার্টার আমরা ছাড়ি ১৯৮৮ সালে। কিছুদিন পরে পুরনো পাড়া দিয়ে যাওয়ার সময়ে দেখলাম, কোয়ার্টারের নতুন মালিক পুরো বাগান কেটে পরিষ্কার করে ফেলেছে। রেখে দিয়েছে শুধুমাত্র আমার দিদুর পোঁতা একটা মনসাগাছ!- পাপের ভয়ে আর কি! আর কি কারণে যেন কাঠগোলাপ গাছটাকে রেহাই দিয়েছে।(৩)১৯৮৮ সালে আমরা চলে আসি শিল্পনগরীর সংলগ্ন এক এলাকায় নিজেদের বাড়িতে। এই বাড়ির সামনে এবং পেছনে বেশ কিছুটা করে জায়গা ছিল বাগান করার জন্য। এই নতুন বাগান কে সাজিয়ে তোলার জন্য কোয়ার্টার থেকে চলে আসার সময়ে নিয়ে আসা হল বেশিরভাগ পছন্দসই গাছের ডাল, কলম এবং বাল্বগুলি। বেশি জায়গা থাকায় এই বাগান তৈরি হল আরো যত্ন করে। সামনের গেট থেকে বাড়ি অবধি যে পথ চলে গেছে, তার বাঁদিক ঘেঁষে লাগানো হল সারে সারে সুগন্ধী ফুলের গাছ, কারণ সেদিকটা হল দক্ষিণ দিক। শিউলি, হাস্নুহানা, স্বর্নচাঁপা, কাঁঠালিচাঁপা, কামিনী, গন্ধরাজ, মধুমালতী, লিলি। ডান দিকে গোল লন। লনের চারিদিক ঘিরে বাইশ রকমের গোলাপ গাছ। শীতকালে বাগানের বিভিন্ন অংশ রঙে ভরে তুলত গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া আর বৈজয়ন্ত। টবে নানারকমের বাহারি চেহারার গাছ। সাদা, হলুদ, লাল, কমলা, গোলাপি জবাফুল। কুন্দ, কাঞ্চন, ফুরুশও জায়গা পেল এই বাগানে।পেছনের বাগানে পেঁপে, লেবু, আম, স্থলপদ্ম, নয়নতারা, কলা, লঙ্কা। সাথে থাকত মরসুমি সিম, মটর, গাজর, টমেটো, ধনেপাতা, এমনকি একবার ভুট্টাও ফলানো হয়েছিল। আমার বাবা অপরিসীম পরিশ্রম এবং যত্নে সাজিয়ে তুলেছিলেন এই বাগান। গত বছর এই বাগান সুদ্ধ বাড়ি বিক্রি করে আমার বাবা মা চলে এসেছেন কলকাতার কাছাকাছি।(৪)চলে আসার সময়ে , আমা্রই ইচ্ছায়, নিয়ে আসা হয়েছিল কয়েকটি টব সুদ্ধ গাছ, আর কিছু গাছের বাল্ব। সেগুলিকে বিভিন্ন টবে পুঁতে রাখা আছে আমার ফ্ল্যাটের ছাদে। সর্বসাকুল্যে কুড়িটা টব নিয়ে আপাতত আমার বাগান। নিয়মিত জল দেওয়া ছাড়া আর বিশেষ পরিচর্যা কিছুই তেমন করা হয়না। কিন্তু যখন হটাত করে একটা নতুন কুঁড়ি ফোটে, বা একটা নতুন পাতা দেখা দেয়, তখন এক অন্যরকম ভাললাগায় মন ভরে যায়।অনেক চেষ্টায় একটা টবে লাগাতে পেরেছি শৈশবের স্মৃতিতে রঙিন হয়ে থাকা সন্ধ্যামালতীর চারা। কিন্তু ফুল কিছুতেই ফুটছে না। আমি অবশ্য হাল ছাড়ছি না। আশা রেখে চলেছি - এক না একদিন বিকেলবেলা ছাদে উঠে দেখব, আমার এক টুকরো বাগান আলো করে রয়েছে ম্যাজেন্টা রঙা কয়েকটা ফুল।