তখন আমি ক্লাস টু। বোধ হয় সদ্য ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়ে নতুন ক্লাসে ওঠার অপেক্ষায় বা উঠেছি, পড়াশোনার তেমন চাপ নেই। আমাদের ব্লকের পেছনের ব্লকের একতলাতেই একটা কোয়ার্টারে 'ছন্দম' এর ক্লাস হয় - নাচ এবং গানের। সেই স্কুলের প্রধান বিমলকাকুই সম্ভবতঃ উদ্যোগটা নিয়েছিলেন --- পাড়াতে হবে বসন্তোৎসব।

দোলপূর্ণিমার আগের প্রায় মাসখানেক ধরে কী উত্তেজনা। সন্ধ্যা হলেই সবাই মিলে উল্টোদিকের প্রাইমারি স্কুলের ক্লাসঘর খুলে অনুশীলন হচ্ছে। মাঝে মাঝে পাঠ, মাঝে মাঝে গান মিলিয়ে তৈরি হয়েছে গীতি আলেখ্য --- তাতে অংশ নিচ্ছেন পাড়ার সমস্ত কাকিমা আর মা। সবাইকে পরিচালনা করছেন গানের মাস্টারমশাই নারায়ণ মিত্র। মাস্টারমশাই ভরাট গলায় গেয়ে উঠলেই মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতারা নিশ্চুপ। রিঙ্কুদি আমাদের স্কুল সিনিয়র, আর যখন নাচে, এত ভালো লাগে যে হাঁ করে তাকিয়ে দেখি। সেই রিংকুদি আমাদের নাচ শেখাচ্ছে- 'ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল... ' আমি, টিংকু, টুকুন, মান্তু, মাম, সুইটি ... আমরা সবার থেকে ছোটদের দল। আমাদের থেকে একটু বড়দের জন্য আরও কত অন্য গান - ' আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি ', দখিন হাওয়া জাগো জাগো', 'ধীরে ধীরে ধীরে বও অগো উতল হাওয়া', 'বসন্তে ফুল গাঁথল...' । শুনে শুনে আর দেখে দেখে আমাদের বড়দের সব গান মুখস্থ হয়ে গেল, নাচের স্টেপ মনে গেঁথে গেল। দোলাদি, চম্পাদি, পিয়ালিদি, মিংকি দি,পিংকিদি, মনা দি, বুলাইমাসি... পাড়ার প্রায় সব মেয়েরা নাচে অংশগ্রহণ করেছে। তবে ছেলেদের বোধহয় দর্শক আর ভলান্টিয়ার হওয়া ছাড়া কোনো ভূমিকা ছিল না।

অবশেষে দোল এল। সকাল বেলা মত্ত হয়ে রং খেললাম। পাশের কোয়ার্টারের প্রসূন কাকু এক খানা সাদা শার্ট পরেই বেরোলেন। স্কুলে স্টেজ তৈরি হচ্ছে, রাতের খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে, সেসব দেখতে। আমরা কাকুর সাদা শার্টকে মনের আনন্দে লাল সবুজ রঙে ভরালাম। বাবা আর পাড়ার কাকুরাও বেরোলেন বেলার দিকে, বেশিরভাগের পরনে সাদা পোশাক। প্রতিবছরই এমন ভাবে সেজে বাবারা সারা পাড়া ঘুরে ঘুরে সবাইকে আবির দিতেন, কোলাকুলি করতেন। আমরা ততক্ষণে রং মেখে ভূত হয়ে বাবাদের পেছন পেছন ঘোরাঘুরি করতাম। পাড়ার যে সব কাকুদের অকারণে ভয় পেতাম, সেদিন তাঁদেরকেও হা হা করে হাসতে দেখে আর অতটা ভয়াবহ মনে হত না। দুপুরের হইচই এর পরে বিকেল না হতে সাজসাজ রব। লাল পাড় সাদা শাড়ি আর সাদা কাগজের মালা-চুড়ি ইত্যাদি পরে সবাই হুড়মুড় করে সেজে নেওয়া গেল। বাড়ি থেকেই বোধ হয় সেজে গেলাম। যথাসময়ে স্টেজে উঠে অনুষ্ঠান। চোখের সামনে গোটা তিনেক ফ্লাড লাইট। উল্টোদিকের চেহারাগুলো সব ঝাপসা... তারই মাঝে ঘুরে ঘুরে ... ' ওরে গৃহবাসী...' ।

অনুষ্ঠানের সময়ে কেউ ছবি তুলেছিলেন কিনা জানি না। মৃত্যুঞ্জয় নন্দী কাকু নিশ্চয় তুলেছিলেন, কারণ কাকুর ছবি তোলার অভ্যাস ছিল। সে তো আর মোবাইলে পুট করে শাটার টেপার যুগ নয়। একটা রিলের একটা ফ্রেম অনেক ভেবে লোকে খরচ করত। তেমন তেমন লোক হলে ভালোবেসেও খরচা করত। যেমন নন্দী কাকু ভালোবেসেই আমাদের বেশিরভাগ পাড়ার পিকনিকে এসে নিজেই ছবি তুলে যেতেন। বাবা নিজের ক্যামেরায় কয়েকটা ছবি তুলেছিলেন। খুব স্পষ্ট নয় সেগুলি, ছবিতে একেবারে ফ্লাড লাইটের সামনে আমরা কুচোকাচারা যে কয়জন বসে ছিলাম, তাদের মুখই মোটামুটি দেখা যায়। তবুও এই সাদা কালো ছোট্ট ছবিটার দিকে খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখের সামনে সেই স্টেজ- গান- বাজনা- হইচই-সব স্পষ্ট রঙিন হয়ে ফুটে ওঠে।

আজ অবধি এ জীবনে এই একবারই এমন কোনো বসন্ত উৎসবে অংশগ্রহণ করেছি। আমাদের পাড়াতেও এমন অনুষ্ঠান আর পরে হয়েছে বলে মনে নেই। তবে আমাদের সেই বসন্তোৎসব অতি সফল হয়েছিল। অনুষ্ঠানের শেষে রাতে স্কুলেই সবাই খেয়েছিলাম, বোধহয় খিচুড়ি আর বেগুনী ছিল । সেই খাওয়ার জায়গাতে প্রদীপ মৈত্র কাকুর ঝুড়ি নিয়ে এসে চেঁচিয়ে 'বেগুনীইইইই, কে নেবে বেগুনীইইইই...' বলাটা মনে থেকে গেছে। তখন বাইরে স্টেজের সামনের ফ্লাড লাইটগুলো নিভে গেছে। আকাশে একখানা পরিপূর্ণ গোল চাঁদ, আর মন ভরা দুঃখ। কাল থেকে আর প্র্যাক্টিস নেই।