দুপুর আড়াইটা কি তিনটে বা হয়ত সাড়ে তিনটে... মানকুন্ডু স্টেশনে থেকে খানিক সুরকি ফেলা, খানিক ইঁট পাতা, খানিক পাথর কুচি বেরোনো রাস্তা ধরে, নিঝুম পাড়ার মধ্যে দিয়ে চলেছে একটা রিকশা। ক্যাঁচ কোঁচ, ক্যাঁচ কোঁচ। রাস্তার দুইপাশে একতলা দোতলা গৃহস্থের বাড়ি। বেশিরভাগ বাড়ি ঘিরে সবুজ বেড়া ঘেরা বাগান, বাগানের বড় বড় গাছপালায় ছায়া ছায়া হয়ে আছে পথ। দুপুরের রোদ সরাসরি গায়ে লাগছে না। রিকশায় আসনে বসে বাবা আর মা। বাবার কোলে আমি,মায়ের কোলে ভাই। সঙ্গে একটা সবুজ কম্বল জড়ানো ধাতব ওয়াটার বটল, একটা লাল চামড়ার কীট ব্যাগ, আরও একটা সুটকেস বা অন্য ব্যাগ। এপথ সেপথ ঘুরে মিনিট দশ-পনেরো পরে সে রিকশা এসে থামল একটা বাড়ির সামনে। গলি জুড়ে তখন পশ্চিমের প্রখর রোদ। দুইপাশে ছোট্ট লাল রোয়াক আর মাঝে ফ্যাকাশে সবজেটে রঙের একখানা কাঠের দরজা। সেই দরজার দুই পাল্লায় দুটো মোটা লোহার কড়া। রিকশা থেকে নেমে মা-বাবা ভাড়া মেটাতে আর জিনিস নামাতে ব্যস্ত, কিন্তু ততক্ষণে আমরা দরজা ধাক্কাতে শুরু করেছি। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হত না, ভেতর থেকে শোনা যেত চেনা গলায় আদর মাখা সুর -' এসে গ্যাচে... এসে গ্যাচে...' আর খুলে যেত দরজা। দরজার ওপাশে একগাল হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছোটদিদু। বাবার ছোটকাকিমা। আমাদের ধরে আদর করার সুযোগ পেতেন না অবশ্য। কারণ ছায়ামাখা, কালো, স্যাঁতসেঁতে ইঁটে ঢাকা আমাদের বাড়ির নিজস্ব গলি দিয়ে ততক্ষণে দৌড় দিয়েছি আমরা। ওদিকে দোতলার ঠাকুর ঘরের জানলা খুলে গেছে, দেখা যাচ্ছে দিদুর মুখ। দোতলা যাওয়ার দরজা দিয়ে ঢুকে দৌড়ে সিঁড়ি । সে কী কম সিঁড়ি! সোজা ,খাড়া , নাহোক গোটা কুড়ি সিঁড়ি দিয়ে উঠে সোজা দোতলা। পুরনো দিনের বাড়ি, উঁচু উঁচু দেওয়াল, আজকের মত দশ ফুটে শেষ নয়। আর ওপরে পৌঁছানো মানেই শুরু হয়ে গেল ছুটি - পুজোর ছুটি। আর পুজোর ছুটি মানেই সারাদিন হইচই - টিভিতে চিচিং ফাঁক- রেকর্ড প্লেয়ারে বুদ্ধু-ভূতুম, লালকমল-নীলকমল, গুপীগাইন বাঘা বাইনের গান শোনা- ঠাকুর দেখা- হলুদ-গোলাপি মঠ-কদ্‌মা-ফুটকড়াই-ভুট্টার খই খাওয়া, বাবুর বাজারের মেলায় গিয়ে প্রচুর খেলনা বাটি কেনা আর হ্যাঁ, ছোটদাদুর দোকান থেকে পুজোর নতুন জুতো নেওয়া।

সেই ঠান্ডা লাল মেঝে, কড়ি-বরগাওয়ালা ছাদ, সবুজ খড়খড়ি আর সবুজ বরফি ছাঁচের শিক দেওয়া মানুষের থেকেও লম্বা সারি সারি জানালাওয়ালা, পলেস্তারাবিহীন মসৃণ ইঁটের সিঁড়িওয়ালা,গায়ে আটকে থাকা শামুকসুদ্ধ ভারী লোহার ডান-দিক-বাঁদিক ঘোরা জলের কলওয়ালা, দেওয়ালে ইয়াব্বড় মাকড়শা আটকে থাকা পায়খানাওয়ালা আমাদের সেই পুজোর ছুটি আর গরমের ছুটি বাড়িটা; আর বাড়ির পেছনে গাছপালায় ভরা ছায়াঘেরা বিশাল বাগানটা --- যে বাগানকে আলো করে বিকেল থেকে ফুটে থাকত সাদা-হলুদ-ম্যাজেন্টা সন্ধ্যামালতীর দল... সব হারিয়ে গেছে। সেই রাস্তাটা আছে, সেই সদর দরজাটাও আছে, কিন্তু কোনোদিন ওই দরজা খুলে যদি উঁকি মারি, তাহলে এক মূহুর্তে মুছে যাবে মনক্যামেরায় ধরে রাখা সব ছবি, ঠিক যেমন হয় সদ্য জলরঙে আঁকা ছবির ওপরে বেখেয়ালে জলের পাত্র পড়ে গেলে । আমি জানি বাড়িটা বাইরে ভেতরে বদলে গেছে, আমি জানি পেছনের বাগানটার বদলে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্লট মাপা বাড়িঘর। আমি জানি , হাসিমুখে দরজা খুলে আবাহন করার প্রতীক্ষাতে নেই কেউ। তাই বড় হওয়ার পরে বেশ কয়েকবার ওই একই রাস্তার ওপর দিয়ে যাতায়াত করলেও, ভুলেও ঢোকার চেষ্টা করিনি সেই দরজা ঠেলে।

গতবছর একটা নতুন শব্দ শিখেছিলাম - Hiraeth। এই ওয়েলশ্‌ শব্দটিকে সহজে ইংরেজিতে অনুবাদ করা যায় না, তবে ব্যাখ্যা করা যায় এইভাবে-- Hiraeth ...combines elements of homesickness, nostalgia and longing. Interlaced, however, is the subtle acknowledgment of an irretrievable loss – a unique blend of place, time and people that can never be recreated. This unreachable nature adds an element of grief, but somehow it is not entirely unwelcome.। ওয়েলশ্‌ সংস্কৃতিতে এই শব্দটি স্বজন বিয়োগের শোকের সঙ্গে মিশিয়ে দেয় ঘরে ফেরার , দেশে ফেরার আকুলতাকে। এই ঘর বা দেশ যতটা না আক্ষরিক, ততটাই বোঝাতে পারে এমন সব স্থান অথবা 'কাল'কে, যেখানে ফিরে যাওয়া অসম্ভব । প্রায় তিন দশক ধরে মহানগরীর জটিল যাপনের মধ্যে ক্রমে ডুবে যেতে যেতে এমন ব্যথাদীর্ণ আকুলতা ফিরে এসেছে বারে বারে - সেই আকুলতার কোনো 'এক কথায় প্রকাশ করো' - গোছের নাম ছিল না। গত বছর থেকে, জীবনে এক ভাইরাসের আগমনে এমন আকুলতার নাম খুঁজে পেয়েছি -হিরায়েথ।

যত দিন যাচ্ছে, ৫ নং শেঠ লেন, কৃষ্ণপট্টির সেই বাড়িটার জন্য, শেষ বিকেলের সেই ঝল্‌মলে সন্ধ্যামালতীর ঝোপগুলোর জন্য আমার হিরায়েথ ক্রমে গভীর ও তীব্র হয়ে উঠছে।