ছবি তোলা আর সীগালের পাল

২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে , ভাই-এর একগাদা বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গেলাম বেনারস। সপ্তাহখানেকের ছুটি, - সে এক অভাবনীয় আনন্দদায়ক ভ্রমণ ছিল। সঙ্গে করে নিয়ে গেছি আশিস্‌দার একখানা পুরনো ডিজিটাল ক্যামেরা। আশিসদা বরিষ্ঠ পেশাদার ফোটোগ্রাফার, একবারের আবদারে তার কিছুদিন আগেই আমাকে নিজের একখানা পুরনো ভালো ডিজিটাল এস এল আর ক্যামেরা ব্যবহার করতে দিয়েছেন, পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে ছবি তোলার জন্য। যতদূর মনে পড়ে, সেই ক্যামেরাতে একবার শাটার টেপার পর, একটা নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করতে হত পরের শট নেওয়ার আগে।

আমি ফোটোগ্রাফি নামক শিল্পের 'ফ' ও বুঝিনা। লেন্স কী ও কেন-এর তাত্বিক ধারণা আছে কিছু, ফোকাস অল্প বুঝি, অ্যাঙ্গেল খানিক বুঝি, ফ্রেম আর পার্স্পেক্টিভ কাকে বলে জানি। এর বাইরে অ্যাপারচার, ফোকাল লেংথ, লাইট ইত্যাদি কঠিন কথা বললে, আমি মাথাতে নেওয়ার চেষ্টাই করিনা।

ডিজিটাল ক্যামেরার আনন্দ বা দুঃখ, যাই বলা হোক, সেটা এই যে, মোটামুটি সোজা আর স্থির করে ধরে রাখতে পারলে, আর আলো ভালো থাকলে, বেশিরভাগ ছবিই দিব্যি উৎরে যায়। তার জন্য আলাদা করে আর ধৈর্য্য ধরে সঠিক মূহুর্তের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। সঙ্গে ফিল্ম খরচের চাপ নেই, খচাখচ তোলো, পছন্দ না হলে ফটাফট ডিলিট, তারপরে ডিজিটাল মেমরিতে রেখে ভুলে যাও। তাই আমিও দিব্যি বড়সড় এক ক্যামেরা বাগিয়ে বেনারসের ঘাটে ঘাটে এদিক ওদিক খচাখচ শাটার টিপতে লাগলাম।

কিন্তু ওটুকু করলেই তো আর হল না, আমার সঙ্গে গেছে যারা, তারা সবাই প্রায় ফটোগ্রাফিটা বেশ ভালো বোঝে, চর্চা করা। ক্যামেরা বোঝে, ছবি বোঝে, ফ্রেমিং আর কম্পোজিশন বোঝে। তাই আমি যতই বাঁদরের আর ষাঁড়ের আর মন্দিরের আর ছাইমাখা সাধুর আর নদীর আর নৌকার আর কুয়াশার ছবি তুলি না কেন, কিছুতেই আর মনোমত হয়না। আমার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ভাই কিংবা স্নেহাংশু একটা ছবি তুলল, একই নৌকাকে তাক করে, তোলার পরে দেখলাম সেই ছবিটা কেমন অন্যরকম ভালো দেখাচ্ছে। কিংবা ঠিক যে সময়ে মাঝি অসিম উদাসীনতায় ক্যামেরার দিকে চোখ ফিরিয়েছে, সেই মূহুর্তটা ফ্রেমবন্দী করে ফেলেছে ওরা। তার মধ্যে বিপ্লব ভোরের সুর্যের আলো ব্যবহার করে , নদীর ধারে মেলে রাখা শাড়ি, ধুতি আর কাজকর্ম করা মানুষদের বিভিন্ন লেয়ারে, এক ফ্রেমে ফেলে প্রচুর ভালো ছবি তুলছে; সেটাকে বোধহয় বলে 'ব্যাকলাইট এফেক্ট' (অন্য কিছুও নাম হতে পারে, ভুলে গেছি)। আমি দুইদিনের চেষ্টায় একখানা দশ শতাংশ কাছাকাছি গোছের ওইরকম ছবি তুলে যেই দেখালাম, অমনি বলে- আমি শেখালাম, এবার টিনের বাক্সে বারো টাকা দাও!

এইসব করেই চলছিল। গোটা পাঁচেক ফোটোগ্রাফারের সঙ্গে থেকেও আমি 'টাইমিং' আর শিখে উঠতে পারলাম না। তাতে খুব দুঃখিত ছিলাম তা নয় - দুনিয়ার সব কিছুই আমাকে পারতেই হবে --- মেগাসিরিয়াল নায়িকার মত এমন মাথার দিব্যি তো নিজেকে দিয়ে রাখিনি। তারপরে আসার দিন সকালে একবার নৌকা চড়তে যাওয়া হল।প্রথম বা দ্বিতীয় দিনে সন্ধ্যাবেলায় চড়েছিলাম। মাঝনদীতে একটা অন্য নৌকা এসে আমাদের কাছে মুড়ির প্যাকেট বিক্রি করে বলে গেল - জলে ছড়াও, ওই পাখিগুলো আসবে। গত কয়েকদিনে নদীর মাঝে নৌকাগুলোর ওপরে সাদা সাদা পাখিগুলোকে খুব ঘুরতে দেখেছি। কেন ঘুরছে বুঝতাম না। আজ বুঝলাম। একবার শুধু প্যাকেট খুলে জলে মুড়ি ছড়ানোর অপেক্ষা! অমনি ঝাঁকে ঝাঁকে পরিযায়ী সীগাল, অবিকল সেই 'ফাইন্ডিং নিমো'-র সীগালগুলোর মত করে 'আও দাও, দাও দাও, খাও খাও' করতে করতে ধেয়ে এল।
দোদুল্যমান নৌকার ওপরে আমরা প্রবল উত্তেজিত হয়ে , একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে ঘুরে খচাখচ শাটার টিপছি। একজন উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। কোনো একটা পাখিকে তাক করার প্রশ্নই নেই, কেউই কয়েক মূহুর্তের বেশি এক ফ্রেমে থাকছে না। তার মধ্যে আবার মুড়িও ছড়ানো হচ্ছে। পাখিতে আর মানুষে সে কী জোর কলরব! আমি একটা সময়ে আর ক্যামেরায় চোখই রাখিনি। বন্দুকের মত এদিক-ওদিক তাক করে শুধুই শাটার টিপে গেছি। সেই করে পাখিদের কিছু ছবি ধরা পড়ল আমার ক্যামেরাতেও।
এই ছবি তেমনি এক 'স্লাইস অফ লাইফ' ছবি। এটা ( কিংবা একই গোছের আরেকটা ) দেখে আমার সেইসব ভ্রমণসঙ্গী, ছবি-বিজ্ঞ ভাই-বেরাদরেরা সার্টিফিকেট দিল- এটা বেশ ভালো ছবি হয়েছে । কিন্তু আমি জানি, এতে আমার কোনো কেরামতি নেই। পুরোটাই একটা যন্ত্রের কেরামতি, আমি শুধুই 'রিফ্লেকটেড গ্লোরি' উপভোগ করি মাঝে মাঝে।