পেরিয়ারের জঙ্গলে

২০০৮ সালে একটা ছোট দলের সঙ্গে কেরালা বেড়াতে গেছিলাম। দুই রাতের মত ছিলাম কেরালার পেরিয়ার রিজার্ভ ফরেস্টে । মধ্যের দিনটিতে আরোও সাতজনের সঙ্গে আমি পেরিয়ারের জঙ্গল সাফারিতে গেছিলাম। আট ঘন্টা ধরে পেরিয়ারের জোঁকে ভরা জংগলে, মাকড়সার জাল, কাঁটাঝোপ ইত্যাদি সরিয়ে অ- নে- ক হাতি দেখার আশায় ঘুরেছিলাম। তার মধ্যে ঘন্টাদেড়েক বোধ হয় ছিল পেরিয়ার লেকে বাঁশের ভেলায় করে একদিক থেকে অন্য দিক যাওয়া এবং আসা, আর মধ্যে দুইবার খাওয়ার জন আধা ঘন্টা করে ব্রেক। আমাদের ভাগ্য খারাপ, সারাদিনে একটা বাঘের ( বা ঐ জাতীয় কোনোও পশুর ) পায়ের ছাপ আর অ-নে-ক দূরে জঙ্গলে মিশে থাকা একটা মাত্র হাতিকে দেখে ফিরে আসতে হয়েছিল। ফাউ ছিল গায়ে সেঁটে থাকা রক্ত খেয়ে নিঝুম দুটো জোঁক।

অগাস্ট মাসের তৃতীয় সপ্তাহে , প্রখর রোদে ওইরকম ভয়ানক হাঁটাহাঁটি করে গায়ের চামড়া লাল হয়ে গেছিল আর হাত-পায়ের জোড় সব খুলে গেছিল। মাঝে লেকের জলে ওই বাঁশের ভেলা চেপে যাওয়া আর ফেরার সময়েই বেশি আনন্দ পেয়েছিলাম। ভেলার ওপর বাঁশের সীটে পাশ ফিরে বসে জলে পা ডুবিয়ে দিয়েছিলাম, সর সর করে জল সরে যাচ্ছিল, অদ্ভূত আরাম লাগছিল।

ছবিতে যে দুইজন মানুষ, তাঁরা এবং আরও এমন তিন-চার জন ছিলেন আমাদের রক্ষী এবং পথপ্রদর্শক। এই দুইজন ( এবং সম্ভবত বাকিরাও) এক সময়ে ছিলেন চোরাকারবারী, সরকার থেকে ট্রেনিং এবং পুনর্বাসন দিয়ে এঁদের জঙ্গলের রক্ষী এবং সাফারি গাইড বানিয়ে দেওয়া হয়। ছবির ডান দিকের জন নৌকা চালাতে চালাতে স্থানীয় ভাষায় একটা লোকসঙ্গীত গাইছিলেন। গানের সুর এবং ওঁর গলা, দুটোই যে খুব ভালো ছিল সেটা মনে আছে।

অসম্ভব ভালো, নরম স্বভাব, অত্যন্ত দায়িত্বশীল সব মানুষ - জঙ্গল সম্পর্কে অনভিজ্ঞ আমি সকালবেলায় প্রথম গাছের গুঁড়ি ফেলা সাঁকো পেরোতে গিয়ে সোজা পপাৎ ধরনীতলে হয়েছিলাম। আমার জুতোটাও অবশ্য জঙ্গলে হাঁটার মত ছিল না। তারপরে সারাদিনে যতগুলো তেমন গোলমেলে জায়গা পেরোতে হল , অন্তত তিন জন আমার আগে পিছে দাঁড়িয়ে থাকতেন, একজন শক্ত করে হাত ধরে পার করাতেন , যাতে কিছুতেই আর পড়ে না যাই।

ফেরার সময়ে , যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, তার মধ্যে পিটপিট বৃষ্টি শুরু হয়েছে, দলের বাকি সবাই আমার থেকে অনেক জোরে হেঁটে বা দৌড়ে আগে চলে গেছে...আমি তখন একেবারে একা হাঁটছি...মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে আশপাশ থেকে কোনো তেমন জন্তু বেরিয়ে না পড়ে... শুধু অনেকটা এগোনোর পর দেখছি আমার ভাই-কাম-বন্ধু বিপ্লব অপেক্ষা করছে... আমি কাছাকাছি পৌঁছালে ও আবার লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। একদিকে জঙ্গল, একদিকে লেক, মধ্যের ঘাসজমি দিয়ে হেঁটে চলেছি আমি, আর আমার পেছনে ,খানিকটা দূরত্ব রেখে একজন রক্ষী। চুপচাপ, কোনো তাড়া দেওয়া নেই, কোনো ভর্ৎসনা নেই, শুধু পেছনে পেছনে থাকা। এই বিশেষ মানুষটি সকাল থেকে আমাদের সঙ্গে ছিলেন ও না। বিকেলের দিকে কোথা থেকে কে জানে এসেছিলেন - হয়ত জঙ্গলের অন্যদিক থেকে, বা মাঝে কোথাও ওঁদের বিশ্রামের জায়গা ছিল, সেখান থেকে..ডিউটি বদল হয়ে বোধ হয় । যতক্ষণ না আমি ধীরে ধীরে, অন্য সবার থেকে অন্তত আধা ঘন্টা বেশি সময়ে নিয়ে, ফরেস্ট গেস্ট হাউজের উল্টোদিকে খালের ধারে বাঁধা পারাপার করার নৌকায় বিপ্লবের সাথে উঠলাম, উনি পেছনে পেছন ওইভাবেই এলেন।

এত ভালো ব্যবহার পেয়েছি --- আমার জীবনের প্রথম জঙ্গল সাফারিতে--- তবুও ঠিক করে ফেলেছি হেঁটে হেঁটে শেষ জঙ্গল সাফারিও ওটাই। আমি গাছপালা -পশুপাখি- বনজঙ্গলের সপক্ষে সবসময়ে কথা বলব, কিন্তু এই বিশাল বপু নিয়ে আর বাপু সারাদিন ধরে 'ওই বুঝি এল হাতি', 'ওই বুঝি গেল হাতি' করে আর কোথাও দৌড়াব না। ওই কাজটা আমার ক্ষমতার বাইরে।