গত সপ্তাহে প্রিয়া প্রেক্ষাগৃহে দেখতে গেছিলাম 'নৌকাডুবি'। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মসার্ধশতবর্ষে ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত এই ছবিটি সুভাষ ঘাই এর নিবেদন। প্রধাণ চরিত্রগুলিতে অভিনয় করেছেন প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়, যীশু সেনগুপ্ত, রাইমা সেন এবং রিয়া সেন।'নৌকাডুবি ' উপন্যাসটি আমি পড়েছিলাম আজ থেকে বছর কুড়ি আগে। তাই কাহিনীর সারাংশটুকু ছাড়া আর বিশেষ কিছুই মনে ছিল না। আর মনে ছিল কিছু টুকরো টুকরো অংশ। ছবিটা দেখে ইস্তক মনে হচ্ছিল কিছু কিছু জায়গা যেন মিলছে না। কৌতূহল ক্রমশঃ বেড়ে উঠছিল পরিচালক গল্পটিকে কিভাবে পরিগ্রহণ/ adapt করেছেন সেই বিষয়ে। তাই মনে হল, ছায়াছবি 'নৌকাডুবি' নিয়ে কিছু লেখার আগে উপন্যাস 'নৌকাডুবি'  আর একবার পড়ে ফেলা উচিত । অতএব, কাজকর্ম ফেলে রেখে গতকাল রাত থেকে আজ সারা সকাল পড়ে ফেললাম অনলাইন রবীন্দ্র-রচনাবলী থেকে এই উপন্যাস।১৩৪৭ বঙ্গাব্দে লেখা এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু যথেষ্ট আধুনিক। কাহিনীর নায়ক নব্য উকিল রমেশ পছন্দ করে তার ব্রাহ্ম বন্ধু যোগেনের বোন হেমনলিনীকে। দেশের বাড়ি থেকে হটাত তলব পেয়ে রমেশ গ্রামে গিয়ে দেখে তার বাবা তার বিয়ে স্থির করেছেন। রমেশ বাধ্য হয় বিয়ে করতে। বৌ নিয়ে নদীপথে ফেরার সময়ে প্রবল ঝড় ঝঞ্ঝায় সমস্ত নৌকা ডুবে যায়। রমেশ  প্রাণে বেঁচে যায়। সে খুঁজে পায় নববিবাহিতা বধূকে। তাকে নিয়ে ঘরে ফেরে সে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই ঘটনাচক্রে রমেশ বুঝতে পারে এই মেয়েটি তার পরিনীতা স্ত্রী সুশীলা নয়। এর নাম কমলা। এবং এর বিবাহ হয়েছিল নলিনাক্ষ নামক এক ডাক্তারের সাথে। এর পরে নানা ঘটনাপরম্পরায় নলিনাক্ষের সাথে কমলার মিলন ঘটে।মূল উপন্যাস 'নৌকাডুবি'র সাথে ছায়াছবি 'নৌকাডুবি'র মিলের শেষ এইখানেই। নায়ক -নায়িকাদের নাম এবং মূল কাহিনীসূত্রটি ছাড়া ছায়াছবির সাথে উপন্যাসের কোথাও কোন মিল নেই। এক কথায় বলা যেতে পারে, ছায়াছবি 'নৌকাডুবি'র কাহিণীর রচয়িতা ঋতুপর্ণ ঘোষ। উপন্যাসের মূল চরিত্রগুলির যে বৈশিষ্ট, সেখানেও ছায়াছবির চরিত্রগুলির অনেক তফাত। মূল উপন্যাসে হেমনলিনীর বাবা একজন নিরীহ দুর্বলচিত্ত ব্রাহ্ম ভদ্রলোক, যিনি সর্বদাই নিজের শরীর নিয়ে চিন্তিত থাকেন। ছায়াছবিতে সেই অন্নদাবাবু একজন অত্যন্ত আধুনিক চরিত্র, যিনি  খুব সম্ভবতঃ একজন দাপুটে ব্যারিস্টারও। উপন্যাসে হেমনলিনীর দাদা যোগেন্দ্র ল' পরীক্ষায় ফেল করে পশ্চিমে হাওয়া খেতে যায়; ছায়াছবিতে সেই যোগেন্দ্র ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত যায়। উপন্যাসের শুরুর দিকে  হেমনলিনী এবং রমেশের সম্পর্ক কখনই প্রকট নয়। ছায়াছবিতে তাদের সম্পর্ক এবং বিবাহেচ্ছা প্রথম থেকেই সুনিশ্চিত। সর্বোপরি, উপন্যাসের হেমনলিনীর তুলনায় ছায়াছবির হেমনলিনী অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, আধুনিকা এবং নিজস্ব মতামতের অধিকারিনী। ঠিক যেমন, উপন্যাসের দ্বিধাবিভ্রান্ত রমেশের তুলনায় ছায়াছবির রমেশ অনেক স্থিতধী এবং বিচক্ষণ। এছাড়াও, মূল উপন্যাস পড়ে কোথাওই মনে হয়না অন্নদাবাবু একজন প্রভূত বিত্তশালী মানুষ। কিন্তু ছায়াছবিতে অন্নদাবাবুর গৃহের অন্দরসজ্জায় এবং  চরিত্রগুলির পোষাক-পরিচ্ছদ-চলনে-বলনে বিত্তশালী, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত, উদার মনস্ক, আধুনিক চিন্তাধারায় পরিপুষ্ট এক ব্রাহ্ম পরিবারের চালচিত্র তুলে ধরা হয়েছে।৬২ পরিচ্ছেদের এই বিশাল ঘটনাবহুল উপন্যাসকে আড়াই ঘন্টার সময় সীমার মধ্যে বলা দুরূহ কাজ। তাই প্রয়োজনমাফিক বাদ দেওয়া হয়েছে অনেক চরিত্র এবং অনেক ঘটনাপরম্পরা। তার বদলে নিয়ে আসা হয়েছে নতুন চরিত্র, নতুন ঘটনা্স্রোত। হয়ত ছবিটিকে মূলস্রোত বানিজ্যিক ছবির স্বাদ দেওয়ার জন্যই এই পরিবর্তন গুলি করা হয়েছে। [ছবিটি হিন্দি ভাষায় মুক্তি পেয়েছে 'কশ্‌মকশ্‌' নাম নিয়ে ]।'নৌকাডুবি' ছবির গতি মূলতঃ ধীর। ছবির প্রথম ভাগের তুলনায় শেষ ভাগে এসে ঘটনাপ্রবাহ হটাত করে গতি পায়। একজন সাধারণ দর্শক হিসাবে ছবিটা দেখতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, কিছু কিছু সময়ে পরিচালক যেন ধরেই নিচ্ছেন যে দর্শক এই গল্পটা আগে থেকেই জানে। তাঁর দর্শকেরা সবাই 'নৌকাডুবি' পড়েই এসেছেন। তাই তিনি অনেক বিষয়, অনেক ঘটনা দুয়েকটা সংলাপের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ করিয়ে নিয়েছেন। আবার কোন কোন দৃশ্যকে মনে হয়েছে অহেতুক দুর্বোধ্য করা হয়েছে। আরো সহজ করা যেত। ছবির ঘটনাস্রোত মূলতঃ সংলাপ নির্ভর। তাই সংলাপ শুনতে ভুল হয়ে গেলেই গল্পের সুতো কেটে যেতে পারে। কাশীতে নলিনাক্ষের গৃহে কমলার প্রবেশ এত দ্রুত এবং ছোট একটি দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে উপস্থাপিত করা হয়, যে কোন দর্শক যদি সেই কয়েকটি মূহুর্তের জন্য অমনো্যোগী হয়ে পড়েন, তাহলে পরের কিছু সময় কার্যকারণ মেলাতেই কেটে যাবে।হেমনলিনীর ভূমিকায় রাইমা সেন স্বচ্ছন্দ। তিনি এর আগেও বহু ছবিতে নিজের অভিনয় দক্ষতা প্রমাণ করেছেন। কৌতূহল ছিল কমলার ভূমিকায় রিয়া সেনের অভিনয় নিয়ে। বাংলা ছবিতে রিয়ার সম্ভবতঃ এটা প্রথম অভিনয়। তিনি যথাসাধ্য নিজের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছেন। রমেশের ভূমিকায় যীশু সেনগুপ্ত সাবলীল। তবে নলিনাক্ষের ভূমিকায় প্রসেনজিতকে একেবারেই মেনে নেওয়া যায়না। চেহারায় বয়সের ছাপ শতেক মেক আপ দিয়েও ঢাকা যায়নি। উচ্চবিত্ত ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত ভদ্রলোক অন্নদাবাবুর ভূমিকায় ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়  তাঁর নিজস্বতা বজায় রেখেছেন।এই ছবিতে কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছে। বেশিরভাগ গান গুলির যথাযথ প্রয়োগ হলেও, শেষ দৃশ্যে, যখন সবকিছু মিটে যাওয়ার পরে রমেশ হেমনলিনীর সাথে দেখা করতে আসে, তখন দেখা যায়, ক্যামেরার দিকে পেছন ফিরে হেমনলিনী গাইছে -'আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর...' এই দৃশ্যে এই গানের ব্যবহারের যৌক্তিকতা আমার কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয়।সিনেম্যাটোগ্রাফি, অন্দরসজ্জা, বহির্দৃশ্য, পোষাক পরিকল্পনা সবই যথাযথ।  এর আগের তৈরি পিরিয়ড ফিল্ম, যেমন 'চোখের বালি' বা 'অন্তরমহল' এর ঘরানাই বজায় রেখেছেন পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ।পরিশেষে একটাই কথা - এই 'নৌকাডুবি' একান্তই ঋতুপর্ণ ঘোষের সৃষ্টি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নয়।