মাধুকরীর তরফে নিবেদিতা এইবারে বিষয় দিয়েছেন -’আমরা কী রেখে যাব'। বিষয় পেয়ে থেকে ভাবছি কী বলতে পারি। একটা ছোট্ট গল্প বলি।

বছর তিনেক আগে আমাদের বাড়িতে পুনে থেকে আসেন আমার ভাইয়ের বন্ধু প্রদীপ। প্রদীপের উদ্যোগে আমাদের পাঁচতলার ফ্ল্যাটের ছোট্ট বারান্দায় গোটা কয়েক মাটির টব বসিয়ে মিনি কিচেন গার্ডেন করার পরিকল্পনা করে আমার ভাই। ব্যাপারটা আমার মোটেও পছন্দ ছিল না। আমাদের বারান্দা উত্তর-পশ্চিমমুখী, ভালো রোদ পায় না, এখানে গাছ হওয়ার অসুবিধা আছে। তাই খুব গজগজ করেছিলাম- কে দেখবে, কে যত্ন নেবে এইসব আর কী। তারপরে গত তিন বছরে টুকটুক করে কম শাক-সবজি চাষ করলাম না! যেটা হয়েছে, সেটাকে চাষ বলে না, সেটাকে শখ বলে। এই তিন বছরের বিভিন্ন সময়ে, পুদিনা, মেথি, উচ্ছে, লাল-হলুদ-সবুজ ক্যাপসিকাম, টমেটো, কুমড়োলতা, পুঁইশাক, ছোলা-মটর শাক, আদা, পেঁয়াজশাক, রসুন শাক, কত কীই তো ফলাতে চেষ্টা করলাম। বাজার থেকে বীজ এনে নয়, রান্নাঘরের বাতিল বা পচে যাওয়া বীজ, শিকড়ের টুকরো এইসব দিয়ে। কোনোটা ভালো হল, কোনোটা অনেক হল, কোনোটা একেবারেই হল না বা খুব কম হল। কিন্তু একটা নেশা চেপে গেছে এখন। আর কী কী গাছ সহজে লাগানো যায় আর কী কী চাষ করা যায়, ভাবতে থাকি সর্বক্ষণ।

এর মাঝে গতবছর কয়েকটা গাছ উঠল, সেগুলি যে কীসের গাছ, বুঝেই উঠতে পারিনা। অসীম ধৈর্য্যে অপেক্ষায় থাকি- ফুল বা ফল কিছু তো একটা আসুক। তারপরে একদিন ফুল হয়ে, ফল এল। সরু , লম্বা, বীনের মত দেখতে ছোট ছোট ফল। আমরা খুব উৎসাহে ভাবলাম, নির্ঘাৎ বরবটি গাছ এগুলো। একদিন সেই ফল কাঁচা সবুজ থেকে লালচে এবং শুকনো হল। তখন কয়েকটা ফল তুলে, পরম আগ্রহে বীজ বের করে চমকে গেলাম। চেনা চেনা শ্যাওলা সবুজ রঙের গোটা গোটা, মুগের দানা । কয়েকদিনের তফাতে, গোটা তিনেক গাছে, সব মিলিয়ে তিন চামচ ও মুগের দানা হয়নি। এই অভিজ্ঞতাটা না, আমাকে খুব নাড়িয়ে দিয়েছে। আমি সেই তিনটে গাছ থেকে পাওয়া দুই চামচ মুগের দানা দেখে হঠাৎ অনুভব করতে পেরেছিলাম, কত কত কত মুগের দানা থেকে চারা করে, আদর যত্নে বড় করে, সেই গাছের ফল থেক বীজ জমা করলে তবে এক কেজি , দশ কেজি বা এক কুইন্টাল মুগ ডাল জমা হয়; তারপরে চাষী সেই ডাল নিয়ে আড়তে বিক্রি করেন, তবেই টাকা রোজগার করেন। সেই কষ্টে চাষ করা জমিতে, সারে-জলে বড় করা ফসল যদি হঠাৎ বৃষ্টি কিংবা খরার ফলে বা পোকামাকড়ের উপদ্রবে নষ্ট কয়ে যায়, তাহলে কতটা কষ্ট হতে পারে। আমার সেই তিন চামচ মুগের দানা আমি প্রাণে ধরে খাইনি কতদিন। চকচকে সবুজ, নরম দানা থেকে কালচে সবুজ, শুকনো দানা হয়ে গেল, তবুও খেতে পারছিলাম না, দেখে বেশি আনন্দ হচ্ছিল। মাঠ ভরা সুস্থ-সতেজ ফসল দেখলে চাষীদের যে ঠিক কেমন আনন্দ হতে পারে, সেটা বুঝতে পারছিলাম। এর আগে, নতুন ওঠা মেথির চারা চড়াইপাখি মাথা মুড়িয়ে খেয়ে গেছিল, তাই সম্ভাব্য ফসল নষ্ট হওয়ার দুঃখটা একটু হলেও অভিজ্ঞতায় ছিল।এ এক আশ্চর্য সমাপতন যে, সেই সময়ের কাছাকাছিতে মহারাষ্ট্রের কৃষকেরা পথে নেমেছেন ঋণ মকুবের দাবীতে, তাঁদের সুদীর্ঘ মিছিল আর রক্তাক্ত পায়ের ছবি অনলাইনে ভাইরাল হচ্ছিল। আমার বারান্দা বাগানের সামান্য কয়েকটি মুগের দানা আমাকে তাঁদের কথা, তাঁদের হয়ে ভাবতে বাধ্য করেছিল।

সামান্য কয়েকটা মাটির টবে অল্প কিছু গাছ স্বেচ্ছায় বা আমাদের ইচ্ছায় বেড়ে উঠতে উঠতে গত তিন বছরে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, অনেক কিছু জানিয়েছে। বর্ষায় খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি কীভাবে জল-মাটি-পোকা-শামুক মিলেমিশে নিজস্ব এক ইকোসিস্টেম তৈরি করে। দেখেছি গাছেরা কেমন রোদের খোঁজে, জলের খোঁজে নিজেদের চলার দিশা স্থির করে নেয়। কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফল হওয়ার বিভিন্ন ধাপ চোখের সামনে পেরোতে দেখেছি। তবে সব থেকে যেটা বেশি শিখেছি, সেটা হল জীবনের প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা। গাছেদের মত এমন করে নিজের সব কিছু বিলিয়ে দিতে আর তো কাউকে দেখলাম না। প্রায় অনাদরে, অবহেলায় বড় হয়ে উঠেও নিজেকে সবুজ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যেতেও তাদের জুড়ি নেই। এমন জীবন দর্শন কেবল গাছেরাই আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারে। এ শুধু অক্সিজেন-কার্ব-ডাইঅক্সাইড-সালোকসংশ্লেষ প্রভৃতি পড়াশোনার বিষয় নয়, নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করার মত একটা শিক্ষাও বটে।

সবুজ গাছপালাদের সাহচর্য আমাকে ব্যক্তিগতভাবে নম্রতা, দৃঢ়তা এবং সহনশীলতার শিক্ষা দিয়েছে। নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আমার মনে হয়, আমাদের সবার, সুযোগ থাকলে, গাছেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা উচিত। বাড়িতে জায়গা থাকলে একটা বা দুটো গাছ বসিয়ে তাদের যত্ন করা, তাদের সঙ্গে সময় কাটানো উচিত। শুধু বড়রা নয়, একেবারে ছোট্টবেলা থেকেই গাছপালার সংসর্গ আজকের দিনের ছোটদের আরও বেশি প্রয়োজন। রোজ খাবার পাতে যে দ্রব্যগুলি সাজিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেগুলি কোথা থেকে কীভাবে আসছে, সে সম্পর্কে ছোট-বড় সবার ওয়াকিবহাল হওয়া দরকার। এই বিষয়ে গভীর আলোচনা করলে এবং তথ্য জানলে আমরা সেসব দ্রব্যের আলাদা মর্যাদা দেব। দ্রব্যের মর্যাদা দেওয়া মানে দ্রব্য উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং উৎপাদনকারীকেও ( এ ক্ষেত্রে কৃষিপদ্ধতি এবং কৃষকদের) মর্যাদা দেব। আগামি দিনে, স্থানীয় পণ্য এবং দ্রব্য ব্যবহারের দিকে উৎসাহ এবং উদ্যোগ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে চলেছে। সেই ভবিষ্যতের লক্ষ্যেই, আজকের দিনের প্রতিটি ছোট ছেলেমেয়ের গাছপালার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতানো জরুরী।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমি কী রেখে যাব নিশ্চিত নই। যা রাখছি, তার থেকে অনেক বেশি ধ্বংস করছি আমরা, আজকের বড়রা। যা নিচ্ছি, তা ফিরিয়ে দিতে ভুলে গেছি। যা নিজের নয়, তাই নিয়ে কাড়াকাড়ির শেষ নেই আমাদের। সবদিক থেকে সুস্থ পরিবেশ রেখে যাব , এমন কথা বলার জোর আমার নেই। তাই আমার সামান্য সাধ্যে, আমি আগামিদিনের ছোটদের জন্য প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা রেখে যেতে চাই। চেষ্টা করব, আজকের এবং আগামির ছোটদের মধ্যে যদি প্রকৃতি এবং পরিবেশকে ভালোবাসার, শ্রদ্ধা করার, আদরে -যত্নে রাখার অভ্যাস একটু হলেও ছড়িয়ে দিতে পারি।

ফেসবুক লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/photo?fbid=1722502784551241&set=a.1722502337884619