তেসরা মে, ২০০৯, রবিবার। ২০০৯ সালের , এমনকি বাংলা ১৪১৬ সালেরও প্রথম কালবৈশাখী এল কলকাতায়। চৈত্র- এবং বৈশাখ মাস এই বছর কলকাতাবাসীদেরকে , বলা যাতে পারে পুরো পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বুঝিয়েছে "প্রখর দাবদাহ" কাকে বলে !কিন্তু আজ দুপুরে ফিরে এল সেই বহু পরিচিত, বহু আকাংক্ষিত দৃশ্য। চারিদিক অন্ধকার করে, সূর্যের মুখ ঢেকে দিয়ে, ধূসর মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ। হু হু করে উত্তর দিক থেকে ধেয়ে এল ঠাণ্ডা হাওয়া। শুকনো ধুলো উড়ল পাক খেয়ে খেয়ে। বারান্দার তারের জামা-কাপড়গুলোকে যেন কোন শক্তিশালী দৈত্য টেনে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চাইল। ছুটে গিয়ে দরজা-জানালা বন্ধ করার আগেই আমার ঘরে ঢুকে পড়ল দস্যু হাওয়া। উড়িয়ে নিয়ে গেল খবরের কাগজ, রুমাল আর দিনমানের গ্লানি। সত্যি সত্যি এসে গেল কালবৈশাখী।

আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, সেই সময়ে কালবৈশাখী হলে মাঝে মাঝে শিলাবৃষ্টি হত। বৃষ্টিতে ভিজে সেই সাদা সাদা ন্যাপথলিনের বলের মত ঠাণ্ডা বরফের গুলি গুলোকে কুড়োনোর মধ্যে আনন্দ ছিল যত, তার চেয়ে বেশি ছিল প্রকৃতির ভয়ঙকর সৌন্দর্য কে অনুভব করার এক নাম না জানা শিহরন।

একবার, আমি যখন অষ্টম শ্রেনীতে পড়ি, ১৯৮৮ সালে এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। দুপুরবেলা ঘন্টাদুয়েক ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ল, আর তার সাথে হল শিলা বৃষ্টি। এত -এত-এত শিলা পড়ল, যে, সেগুলি আমাদের স্কুলবাড়ির দেওয়ালের ধার ঘেঁসে বরফের স্তূপের মত জলে গেল। স্কুলবাসে করে বাড়ি ফেরার পথে দেখলাম চারদিকের মাঠঘাট জুড়ে চাপচাপ বরফের স্তূপ। আমাদের সাদামাটা গড়ানে মফস্বল যেন হটাত হয়ে পড়েছে সিমলা পাহাড়, অথবা দার্জিলিং। সেইবার এত শিলা জমেছিল যে তিনদিন ধরে সেগুলো একটু একটু করে গলেছিল। আমাদের বাড়ির পেছন দিকের বাগানের দরজা খোলা যায়নি সে কয়দিন।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর দৌলতে আজকাল আর শিলাবৃষ্টি তো দূরঃস্থ, কালবৈশাখীরই খবর পাইনা। কলকাতা শহরে বসে তো এমনিতেও ঋতু পরিবর্তনের খবর বিশেষ পাওয়া যায়না। শহরের ইঁট-কাঠের ফ্রেমের মধ্যে ব্যালকনিতে রাখা মরসুমি ফুল বা ঘরের কোনের শৌখিন ইন্ডোর প্ল্যান্ট এর মধ্যেই যেন সাজিয়ে রাখা প্রকৃতির উদাহরণ। কিন্তু যখন আজকের মত একেকটা দিন আসে, তখন যেন হটাত করে বুঝতে পারি প্রকৃতির ক্ষমতা, তার বিশালত্ব। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুহাত বাড়িয়ে দুরন্ত কালবৈশাখীকে আবাহন করতে করতে নতুন করে, আরেকবার করে অনুভব করি প্রকৃতির তুলনায় নিজের ক্ষুদ্রতা, নিজের অপারঙ্গমতা।

স্কুলে পড়তে হয়েছিল মোহিতলাল মজুমদারের কবিতা 'কালবৈশাখী। সেই সময়ে পুরোটা মানে বুঝতাম না, এখন বুঝি। সেই কবিতার প্রথম দশটি পংক্তি যেন আজ প্রত্যক্ষ করলাম আরেকবার -

"মধ্য দিনের রক্ত নয়ন অন্ধ করিল কে?
ধরনীর পরে বিরাট ছায়ার ছত্র ধরিল কে?
কানন-আনন পান্ডুর করি জলস্থলের নিঃশ্বাস হরি
আলয়ে-কুলায়ে তন্দ্রা ভুলায় গগন ভরিল কে?

আজিকে যতেক বনস্পতির ভাগ্য দেখিযে মন্দ
নিমেষ গনিছে তাই কি তাহারা সারি-সারি নিঃস্পন্দ
মরুত পাথারে বারুদের ঘ্রান এখনি ব্যাকুলি তুলিয়াছে
প্রান পশিয়াছে কানে দূর -গগনের বজ্র-ঘোষোণ ছন্দ"



[অনেকদিন আগে মুখস্থ করা, বই হাতের কাছে নেই, তাই যতিচিহ্ণ ভুল হতে পারে]