আমি কম্পিউটার ব্যবহার করছি গত এগারো বছর ধরে। এই এগারো বছরের মধ্যে কম্পিউটারের নানারকম সফটওয়্যার আমাকে নানাভাবে আকৃষ্ট করেছে। আমার প্রথম ভালোলাগা ছিল গ্রাফিক সফটওয়্যারগুলি, কারন সেগুলি ব্যবহার করে নানারকম ছবি আঁকা যেত। প্রথম ব্যবহার করতে শিখেছিলাম MS Paint, তারপরে Adobe Photoshop, CorelDraw, Flash, যখন যেটা দরকার পড়েছে, শিখেছি। যখন থেকে ইন্টারনেটের সঙ্গে পরিচিত হলাম, তখন থেকে শুরু হল এক অন্যরকম উতসাহ। নতুন নতুন বিষয় জানা, জানা বিষয়ে অজানা তথ্য আবিষ্কার করার এক নতুন নেশায় মেতে গেলাম। কিন্তু এই ডিজিটাল দুনিয়ায় যে বিষয়টি আমাকে একেবারেই উতসাহিত করেনি, সেট হল কম্পিউটার গেমস। আমার ভাই যখন সেই বিখ্যাত মোটরসাইকেল রেসের খেলা "রোডর্যাশ" খেলত, আমি মাঝে মাঝে পাশে বসে দেখতাম। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে আমার যেটুকু উতসাহ ছিল সেটা ছিল ঐ গেমটি তে ব্যবহার করা বিভিন্ন ল্যান্ডস্কেপ গুলি নিয়ে - কোনটা সমুদ্রের ধার দিয়ে, কোনটা বা শহরের মধ্যে দিয়ে, কোনটা বা উঁচু নিচু উপত্যকার মধ্য দিয়ে। ঐ গেমটি দেখার মূল আকর্ষণ ছিল গ্রাফিক্সগুলির মাধ্যমে আমেরিকার বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটু আভাস পাওয়া। কিন্তু এছাড়া আর কোন উতসাহ ছিল না। আমি এমনকি মোবাইল ফোনের গেম গুলিও খেলি না। উইন্ডোস এর সাথে আসা তাস বা অন্যান্য কোন গেমগুলিকে খেলিনি কোনদিন।
অথচ ইদানীং গত দুই-তিন মাস ধরে, আমার যাবতীয় মনোযোগ আকর্ষণ করে নিয়েছে ফেসবুকের বহুল জনপ্রিয় তিনটি গেম - প্রথমে ফার্মভিল [Farmville] , তারপরে ক্যাফে ওয়্ররল্ড [Cafe World], এবং শেষ কিছুদিন যাবত ফিশভিল [Fishville]। ফার্মভিলে নানারকম ভার্চুয়াল ফসল ফলানো যায়, গরু-ছাগল-মুর্গি ইত্যাদি পালন করা যায়; ক্যাফে ওয়ররল্ড এ নিজের ক্যাফে খুলে সেখানে নানারকম রান্না করে বিক্রি করে ক্রেতাদের খাওয়ানো যায়; আর ফিশভিলে নিজের অ্যাকুয়ারিয়মে নানারকম মাছ চাষ করা যায়। বলাই বাহুল্য , চাষের ফসল-ফল-ফুল, ক্যাফের খাবারদাবার এবং অ্যাকুয়ারিয়মের মাছ, সবই বিক্রয়যোগ্য। বিক্রি টাকা রোজগার করে আবার নতুন বীজ কিনে চাষ, বা নতুন খাবার তৈরি করা যায়। এইভাবেই পয়েন্ট বাড়ানো, লেভেল বাড়ানো, নিজের খামারের বা ক্যাফের আয়তন এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধি...। -সমস্ত ধাপগুলিই ভার্চুয়াল, তবে কেউ যদি অত্যধিক উতসাহি হন, তাহলে চটজলদি লেভেল বাড়ানোর জন্য গেমগুলির মালিক জিঙ্গা কে সত্যি সত্যি টাকা দিয়ে একলাফে অনেক ধাপ পেরিয়ে যেতে পারেন।
আমার অত টাকা নেই, তাই আমি ভার্চুয়াল টাকা পয়সার ওপরই নির্ভরশীল। তাই ব্যবহার করে করেই আপাতত আমি একখানা বেশ বড়সড় খামারের মালিক। তাতে নেই নেই করে দুটি বাড়ি, একগাদা গরু-ভেড়া-ছাগল-হাঁস-মুর্গি -কি নেই!! সেই খামারে আমি ইচ্ছামত ধান-গম-ভুট্টা-আঙ্গুর-স্ট্রবেরি-কুমড়ো-আরো কত কি দেশি-বিদেশি ফসল ...যখন যেমন খুশি চাষ করতে পারি। আবহাওয়া-রোদ-জল-মেঘ-বৃষ্টি-মাটি- গ্রামীণ ব্যাঙ্ক...কিছু নিয়েই চিন্তা ভাবনা করতে হয়না। আমি বাঙ্গাল। আমার কোন 'দেশের বাড়ি' নেই বলে মনে খুব দুঃখ । কিন্তু আপাততঃ আমার এদেশি কিছু বন্ধুদের মত বিঘে বিঘে জমির মালিক না হওয়ার এবং rootless হওয়ার দুঃখ ঘুচে গেছে । আমি আমার খামার সম্পর্কে ভয়ানক যত্নশীল। ফসল লাগিয়ে সময়মত সেগুলিকে কেটে ফেলি। পারতপক্ষে আমার ফসল নষ্ট হয়না। যে এক-দুইবার হয়েছে, আমি মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছি।
একইরকমভাবে আমি আমার ক্যাফে এবং আমার অ্যাকুয়ারিয়মকেও খুব ভালোবাসি। সময়মত উনুন থেকে না সরালে রান্না করা খাবার নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক সময়ে খেতে না দিলে ছোট মাছগুলি মরে যায়। খাবার বিক্রি করে পয়সা জমিয়ে জমিয়ে আমি আমার ক্যাফেটাকে বেশ বড় বানিয়ে ফেলেছি। সেটাকে মনের মতন করে সাজিয়েছি। অ্যাকুয়ারিয়মটাকেও নানারকমের গাছপালা দিয়ে সাজিয়েছি।
খেলতে শুরু করার সময়েও ভাবিনি আমি এত বেশি উতসাহিত হয়ে পড়ব গেমগুলিকে নিয়ে। আজকাল দিনের প্রায় বেশ কিছুটা সময় এই খেলাগুলির পেছনে চলে যায়। নিজেই নিজের উতসাহ দেখে অবাক হয়ে যাই। ভেবে দেখেছি, আমার এই গেমগুলিকে ভাললাগার এবং ভালবাসার মূল কারণ হল এই গেমগুলির বিশেষ চরিত্র। এই গেম গুলির মজা হল, এগুলি কোন লড়াই, দৌড়, শত্রুপক্ষ ধ্বংস, অজানা গ্রহের ভয়ঙ্কর প্রানী, কামান , গোলাগুলি, রক্তপাত ইত্যাদি নিয়ে নয়। বরং বাগান ভরা সবুজ ফসল ফলিয়ে নিজের অন্যঅন্য খেলুড়েদের সংগে এক সুস্থ এবং পসিটিভ খেলায় মেতে ওঠা। এই খেলাগুলিতে অন্য খেলুড়েরা শত্রু নয়, তারা হল 'পড়শি' [neighbor]। পড়শির সঙ্গে আর কে লড়াই করে? বরং, এই খেলাগুলিতে পড়শিকে সাহায্য করে টাকা এবং পয়েন্ট পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে তাদেরকে নানা জিনিষ উপহার দেওয়া যায়, তাদের কাছ থেকে নানা উপহার পাওয়াও যায়। সব মিলিয়ে এক উষ্ণ, বন্ধুত্বপূর্ণ, গঠনমূলক পরিবেশ - আমাদের চেনা পরিচিত, বহুল প্রচলিত গেমিং কনসোল এর টান টান উত্তেজনার থেকে বহুদূর। আর সেইজন্যই বোধ হয়, ফার্মভিল পৃথিবীর জনপ্রিয়তম অনলাইন গেমগুলির মধ্যে একটি। এই মূহুর্তে সারা পৃথিবীর 68,075,283 জন মানুষ নিয়মত ফার্মভিল খেলেন। সেইসব মানুষদের মধ্যে আমর মত বহু মানুষও আছেন নিশ্চয়, যারা কোন এক সময়ে কোন রকম গেমস খুলেও দেখতেন না। বেশ কিছুদিন আগে জাপানে নির্মিত একটি গেম সম্বন্ধে জানতে পেরেছিলাম, যেখানে একজন মা এবং তার দুই কিশোরী মেয়েকে খেলুড়ে [রা] একলা বা একসাথে ধর্ষণ করতে পারে। এই গেমটি আমাজম ডট কমে বিক্রি করা হচ্ছিল, কিন্তু আমাজন সেটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিছুদিন আগে খবরে শোনা গেছিল এই গেমটি ভারতে চোরাপথে বিক্রি হচ্ছে। এইরকম গেম নাকি জাপানে খুব জনপ্রিয় এবং অনেক তৈরি হয়। এই ধরনের গেম যখন তৈরি এবং বিক্রি হয়, তখন নিশ্চয়ই এইধরনের গেমের নিজস্ব বাজার আছে। কিন্তু আমার মত একজন সাধারন, শান্তিপ্রিয়, জীবনমুখী মানুষের কাছে, এহেন সুস্থ ভাবনা চিন্তার পরিপন্থী গেমগুলির থেকে ফার্মভিল বা ফিশভিল কিন্তু চারিত্রিকভাবে অনেকাংশে এগিয়ে।
অনলাইন গেমস – আমার নতুন ডিজিটাল অভিজ্ঞতা
- Details
- Written by: Mahasweta
- Category: এই সময়, এই জীবন