ফেলে আসা শীতে, একটা ছোট্ট টবে, একমুঠো সর্ষে ছড়িয়েছিলাম। জানুয়ারির শেষে, যখন স্থান সংকুলান না হওয়ায় গাছগুলি ছোটখাটো চেহারা নিয়েই বুড়ো হয়ে যেতে লাগল, তখন তাদের পাতা তুলে শাক করে খেলাম আর গুটিকয় ফুল সাজিয়ে রাখলাম ছোট্ট এক চীনেমাটির কাপে। সে ছিল জানুয়ারি মাসের শেষ। গত এক মাস ধরে, সেই জলের মধ্যে থেকেই, সেইসব সূক্ষ্ম কিন্তু সবল ডালগুলি শিকড় বের করেছে, ফুলগুলিকে ফলে পরিণত করেছে, সেই নখের থেকেও সরু ফল পরিপুষ্ট হয়ে উঠেছে, তার ভেতরে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সবল সতেজ দানাগুলির অবয়ব পরিস্ফূট হয়েছে দিনে দিনে, কয়েকটি সম্ভবত ফেটে গিয়ে বীজগুলি আমার চোখে আড়ালে পড়েও গেছে। অবশেষে, আজ বাকি থাকা সামান্য কয়টি ফলের খোসা ছাড়িয়ে বের করে আনলাম কয়েকটি সর্ষে দানা।

কীই বা হবে এই কয়টি দানায়? একটা হালকা তরকারির ফোড়ন হতে পারে।কিন্তু যদি মনে ভাবি, আঙুল চেটে খাওয়ার জন্য সর্ষেবাটা দিয়ে রান্না করব, তাহলে এই কয়টি দানা কোনো কাজে আসবে না। তার বদলে যত দানা লাগবে, ততগুলি দানা নিজেই চাষ করে ঘরে তুলতে গেলে আমার বাড়ির এদিক সেদিক রাখা সবকয়টি গাছের টবে শুধুই সর্ষে চাষ করতে হবে। আর চাষ করা মানে শুধু বীজ বোনা তো নয়। বীজ বোনার কাজ অপেক্ষাকৃত সহজ। কঠিন হল সেই বীজকে গাছে রূপান্তরিত হতে দিয়ে, ধৈর্য্য ধরে ফুল ফুটিয়ে, ফল হইয়ে, সেখান থেকে আবার বীজ যোগাড় করা। এর মাঝে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সময়ে অসদব্যবহার হলে হয়ত সেই প্রথম বীজ বোনার প্রয়াসটাই বৃথা যাবে।এই সামান্য কয়টা সর্ষে দানা গুছিয়ে রাখতে গিয়ে আন্দাজ করতে চেষ্টা করি , ঠিক কত কত সর্ষের গাছ পুঁতে বড় করলে, কত বড় ক্ষেত হলে কোনো কৃষক পঞ্চাশ বা একশো গ্রাম বা এক কেজি সর্ষেদানা উৎপাদন করে বাজারে নিয়ে যেতে পারেন। ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারেন কি না সে তো পরের ব্যাপার। চেষ্টা বিফলে গেছে, আন্দাজ করতে পারিনি, 'চোখে ঝিলমিল লেগে গেছে।' এমন 'মাইক্রো' স্তরের কৃষিকাজের অভিজ্ঞতা আমাকে কৃষকদের প্রতি, কৃষিকাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলছে। 'চাষা-ভুষো' হওয়াকে গাল পেড়ে আমাদের পূর্বজরা যে খুব ঠিক কাজ করেন নি, সেটা আজ বুঝি। তার বদলে ছোটবেলা থেকে কিঞ্চিৎ চাষবাস করতে শিখলে আমাদের জীবনবোধ অন্যরকম হতে পারত।

সর্ষেদানা দেখলে আমার গৌতম বুদ্ধকে মনে পড়ে। তিনি এক প্রবল শোকাতুরা রমণীকে বলেছিলেন, তার শোকনিরসনের উপায় রূপে নগরের সব থেকে সুখী গৃহ থেকে এক মুঠো সর্ষে এনে দিতে। এমন গৃহ থেকে আনতে হবে, যে গৃহে এক বিন্দুও দুঃখ নেই। বলাইবাহুল্য, তেমন গৃহ সেই রমণী খুঁজে পান নি। বরং প্রতি গৃহে বিবিধ শোকের বিবরণ শুনে শুনে তাঁর নিজের শোক প্রশমিত হয়েছিল।

এমতাবস্থায়, হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটি মারফত কিছুদিন আগে একখানি অতিজাগতিক কথোপকথন আমার কাছে এসে পৌঁছায়। 'ফেল করার উপকারিতা' শীর্ষক, অবশ্যই কোনো বিশেষ আই টি সেল প্রসূত এই কথোপকথনে , দুটি মেয়ে আলোচনা করছে কেন পড়াশোনা করা উচিত নয়। কারণ পড়াশোনা করলে জুটবে একজন চাকরিজীবি স্বামী, আর ফেল করলে বাবা বিয়ে দেবে চাষীর সঙ্গে। ফেল করে চাষীর সঙ্গে বিয়ে করতে উৎসাহী মেয়েটি জানায় , বিনামূল্যে অর্গানিক সব্জী সহ অন্যান্য নানা সুযোগ সুবিধার ছাড়াও,'... ভোটের পর নতুন সরকার এসে পুরনো লোন মকুব করে দেবে। কোনো EMI দেওয়ার ঝামেলা থাকবে না। আমাদের এই সমস্ত লোন,অর্ধেক দামে বিদ্যুৎ,, জল, এগুলোর ঘাটতি মেটাতে সরকারের কোষাগারে টাকা দেবে কে ? তোর চাকরিজীবী স্বামী!" মাত্র ২৭৫ শব্দে একই সঙ্গে মেয়েদের জীবন, মেয়েদের পড়াশোনার, এবং কৃষিকাজের এমন নিখুঁত সৃজনশীল অবমাননাপূর্ণ রচনা নির্মাণ খুব সহজ কাজ নয়। ফেল করার সঙ্গে সফল সমৃদ্ধ জীবনের এমন সমানুপাতিক অংক মেলানোর প্রক্রিয়া স্বয়ং কেশব চন্দ্র নাগের মাথাতেও আসেনি।

কোনো এক সমান্তরাল দুনিয়ায়, এই অনুগল্পের লেখককে আমি পাঠাতে চাই ভারতের প্রত্যন্ত কোণে ছড়িয়ে থাকা সমস্ত চাষী পরিবারগুলিতে --- কাজ হবে এক মুঠো সর্ষে নিয়ে আসা এমন এক চাষী পরিবারের কাছ থেকে, যাদের জীবনে কোনো দুঃখ নেই, খরা বা বন্যা নেই, ঝড় বাদলে যাদের ফসল কখনোও নষ্ট হয়ে যায় নি, ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে না পেরে যে বাড়িতে কেউ আত্মহত্যা করেনি, অন্যের ক্ষেতে কাজ করার পরে তিন দিন ধরে হেঁটে ফিরতে ফিরতে কেউ মরে যায়নি কিংবা মাসিক হলে বা গর্ভবতী হলে ছুটি নিলে মাইনে কাটা যাওয়ার ভয়ে কেউ স্বেচ্ছায় জরায়ু কেটে বাদ দেয়নি...