গত মঙ্গলবার প্রথমবার কেওড়াতলা গেলাম। এই নিয়ে চারবার যাওয়া হল --- প্রতিবারই বিভিন্ন শ্বশান --- গড়িয়া, বৈদ্যবাটি, রাজপুর, কেওড়াতলা। বিভিন্ন চেহারা, বিভিন্ন অবস্থান, বিভিন্ন চরিত্রের হলেও, পরিষেবা এক। মাঝরাতের কথা অবশ্য জানিনা, কিন্তু ছোটবেলায় এবং বড়বেলায় পড়া কিছু 'ভয়াবহ' গল্পে যেসব গা ছমছম করা শ্বশানের বিবরণ থাকত--- মহানগরের মধ্যে, ঘোর বড়রাস্তার পাশে অবস্থিত এই সমস্ত শ্মশানে দিনে দুপুরে তো দূর, ভর সন্ধ্যাবেলাতেও অন্তত তেমন কিছুই মনে হওয়ার উপায় নেই । মানুষের ইতস্ততঃ জটলাকে সরিয়ে সরিয়ে নিরন্তর এসে দাঁড়াচ্ছে ফুলে সাজানো যত গাড়ি; তারই মাঝে একাগ্রচিত্তে ময়লা ঝাঁটাচ্ছে সরকারি সাফাইকর্মী। শ্মশানের উল্টোদিকেই বিক্রি হচ্ছে তেলেভাজা থেকে সিগারেট, গরম চা থেকে ঠান্ডা পানীয়, পর্দা উড়ছে গৃহস্থের জানলায়। লম্বা লম্বা নারকোল গাছ আর চকচকে চিমনির মাথা ছুঁয়ে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। শ্মশানভূমি নিজগুণে এক রঙ্গমঞ্চ। মলিন, ন্যাড়া দেওয়ালের কোণে জমতে থাকে বালিশ, চাদর, ফুলের মালা, বড় বড় ফুলের তোড়া, মোচা, মাটির ঘট ,প্লাস্টিকের প্যাকেট এবং 'শ্রীমদ্ভগবতগীতা'। হঠাৎ আর্তনাদ, বুকভাঙা কান্না, জায়গা নিয়ে তর্কাতর্কি, না বুঝে উচ্চারণ করতে থাকা মন্ত্র, টাকা নিয়ে দরাদরি, দেশকাল নিয়ে আলোচনা, সামনের রাস্তা দিয়ে চলতে থাকা গাড়ির আওয়াজ---- মিলেমিশে তৈরি হয় আলোকপথযাত্রার সাউন্ডস্কেপ। টাটকা রজনীগন্ধার সুবাসের সঙ্গে ধূপের চড়া গন্ধ মিশে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বাসী ফুল আর পয়ঃপ্রণালীর কুবাস, তৈরি করে শ্মশানের নিজস্ব সেন্টস্কেপ। কোলাপ্‌সেব্‌ল্‌ গেটের পেছনে বন্ধ চুল্লীর ভিতরে, সকলের অলক্ষ্যে প্রস্তুতি নেয় টকটকে লাল আগুন। এমন মিজঁ-অ-সেন সমৃদ্ধ প্রায় পরাবাস্তব পটভূমিতে--- লাইন দেওয়া, ফর্ম ভরা, বাবার নাম থেকে ওয়ার্ড নম্বর অবধি অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের যোগান দেওয়া, ভুল হলে দৌড়াদৌড়ি করা, এবং বিভিন্ন কাজের জন্য গুণে গুণে টাকা দেওয়া --- বা ভালো ভাষায় বলতে গেলে অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দেওয়া--- এমন প্রবল জাগতিক কাজ ঠান্ডা মাথায় সম্পন্ন করতে হয় কিছু মানুষকে। চোখ থাকে ঘড়ির দিকে, ধৈর্য্যের পরীক্ষা হয়। প্রিয়জনের শেষকৃত্য নির্বিঘ্নে সম্পাদন করা প্রায় অফিসের কাজ সফলভাবে জমা দেওয়ার শামিল। পুরোহিতের মুখে ভুল উচ্চারণ শুনে দুটো ভুল মন্ত্র বললে চিত্রগুপ্তের স্বর্গীয় খাতায় সে পাপের উল্লেখ নাও থাকতে পারে , কিন্তু জাগতিক নথীতে কোনো অক্ষর, শব্দ বা সংখ্যা ভুল হলে কাগুজে যত সংযোগ, সম্পর্ক, সুবিধা---সমস্ত নড়বড়ে হয়ে পড়তে পারে। এমতাবস্থায়, শোক, নিতান্ত একাকী, প্রায় আবছা হয়ে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকে --- সব হিসেব-নিকেশ শেষ হওয়ার অপেক্ষায়, ফাঁকা ঘরে ফেরার অপেক্ষায়। তাৎক্ষণিক ঘটনাবহুলতায় তার কথা ভুলে যায় অনেকে, কেউ কেউ তাকে দলা পাকিয়ে আশ্রয় দেয় শুকনো গলার কোণে। ***************
সন্ধ্যাবেলা আমাদের প্রিয়জনের শেষকৃত্য সম্পন্ন হলে অস্থি বিসর্জনের জন্য স্বল্প আলোয় আলোকিত আদিগঙ্গার দিকে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম, শ্মশান চত্বরের মধ্যেই , ফাঁকা কাঠের চুল্লীর আশপাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে বেড়াচ্ছে কিছু ছোট ছোট ছেলে। তাদের পোশাক ও সাইকেলের চাকচিক্য বলে দেয়, তারা পথশিশু নয়, স্থানীয় অধিবাসী। দেখতে দেখতে ভাবলাম, এই সব বাচ্চারা কি শ্মশান নিয়ে নানাবিধ অলৌকিক কিংবা ভয়াবহ গল্প পড়ে মাঝরাতে ভয় পায় ? কে জানে! কমিক্সে-গল্পে-বিজ্ঞাপনে-সিরিয়ালে যেখানে যত যমরাজকে দেখা যায়, প্রায় তেমনই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মহাকায় কিছু মানুষ গতকাল কেওড়াতলাতেও পুরোপুরি পেশাদারী সক্রিয়তায় শেষকৃত্য সম্পাদনে সাহায্য করছিলেন। তাঁদের দেখে মনে হল, আমাদের যত পুরাণে বা আধুনিক কমিক্স-কার্টুন-সিরিয়ালের বিশালবপু, বলশালী, কৃষ্ণবর্ণ যমরাজার চিত্রায়নের উৎস বা অনুপ্রেরণা কি এমনই সব মানুষ? নাকি যুগযুগান্ত ধরে এমন চিত্রায়ন হল বলেই তাঁদের পেশা এমনভাবে নির্দিষ্ট হয়ে গেল? শ্মশানচারী নীলকন্ঠ শিবকে মনে পড়ল। ব্রহ্মান্ড রক্ষার প্রয়োজনে তিনি সমুদ্রমন্থনে উঠে আসা হলাহল নিজ কন্ঠে ধারণ করেছিলেন। যাঁরা দিনের অনেকটা সময় ধরে নির্বিকার মুখে, নিখুঁত যান্ত্রিকতায় একের পর এক শেষকৃত্যের কাজ করেন, প্রতিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে সাহায্য করেন, শোকার্ত মানুষের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে কঠিন কাজগুলো অবলীলায় এবং অবহেলায় করে দেন, তাঁরাও কি এক অর্থে নীলকন্ঠ নন? হলাহল কি সত্যই কঠিন গরল ছিল? নাকি আসলে ছিল বাঁধ না মানা শোকের প্লাবন? যে শোক দলা পাকিয়ে থাকে শুকনো গলার কোণে ? ( গত মঙ্গলবার আমাদের এক অতি প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয়া বরিষ্ঠা, আমাদের এক দিদা, যাঁর কাছে গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে অনেক আদর পেয়েছি, কিন্তু গত দুই বছরে অতিরিক্ত সতর্কতার বশে যাঁর মুখোমুখি গিয়ে দু-দন্ড বসার সাহস সঞ্চয় করে উঠিনি, তিনি আলোর দেশে চলে গেলেন। তাই কেওড়াতলা গেছিলাম। )