বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ জগ্‌গা জাসুস দেখে ফিরে এসে অনেকদিন পরে একটা কিছু লেখা। এটি ছবিটির গুরুগম্ভীর সমালোচনা ব্যতীত আর সব কিছু।

গত মঙ্গলবার 'জগগা জাসুস' দেখতে গেছিলাম। ফিল্মটা দেখে কেমন লাগল, শুধুমাত্র সেই নিয়ে বিশ্লেষণী মতামতের জন্য এই লেখা নয়। তার সাথে লেখাটা আরো অন্যান্য অনেক কিছু নিয়ে। হঠাৎ সিদ্ধান্তে কিংবা প্রচুর ভাবনা চিন্তা করে, যেভাবেই হোক না কেন, ফিল্ম দেখতে যাওয়া মানে তো আর শুধু ফিল্মটা নয়, তার আগে পিছে ডাইনে বাঁয়ে সবকিছুই আমার কাছে সমানভাবে আকর্ষণীয়। বাজারে গেলে সব্জীর থেকে সব্জীওয়ালি মাসির সংসারের গপ্পে বেশি মন দিই, রেস্তোঁরায় খেতে গেলে নিজের পাতের চেয়ে অন্য টেবিলগুলির ছোট ছোট যে সব গল্পগুলি তৈরি হচ্ছে তাতে বেশি মন থাকে। সুধী পাঠক, এই অতিদীর্ঘ পোস্ট পড়া শুরু করার আগে তাই বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দেওয়া রইল। শেষে গিয়ে রেগে গেলে আমি দায়ী নই।

একবার এক প্রকাশক বন্ধুর নিমন্ত্রনে শহরের এক নামজাদা বইয়ের দোকানে তাঁদের সদ্য প্রকাশিত এক বইয়ের আনুষ্ঠানিক উদবোধনে পেছনের সারির দর্শক হয়ে গেছিলাম। বইটি ইংরেজিতে লেখা, লেখক ১০০% খাঁটি সায়েব। সেখানে কলকাতার সব 'হুজ হু' রা উপস্থিত ছিলেন। সেটাই আমার জীবনে প্রথমবার ( এবং আপাতত শেষ বার) এরকম কোন অনুষ্ঠানে যাওয়া। আমি ছাপোষা, নিম্নগামী-মধ্যবিত্ত, আটাশ পরগনার বাসিন্দা ( আজ্ঞে হ্যাঁ, এখনও আমার পরিচিত বহু মানুষ, যাদবপুর থানার ওপাশ থেকে যাঁদের বাড়িঘর, তাঁরা বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলী অঞ্চলকে বঙ্গোপোসাগরের মোহনা ভাবেন, কিন্তু গায়ে-গায়ে-লাগা-সেলেব্রিটি-ঠাসা গড়িয়াকেও মোহনা ভাবেন কিনা জানিনা )। জীবনে এত এত পেজ থ্রিতে দেখা নিখুঁত রূপচর্চা করা মুখ, শপিং মল আর লাইফস্টাইল পত্রিকায় দেখা জামাকাপড়, ব্যাগ- জুতো-গয়না আর কল্পিত সুরভী এক সাথে দেখিনি এবং শুঁকিনি। তাই প্রচুর মাপা হাসি, চাপা গুজগুজ-ফুসফুস-খুকখুক, কেতাদুরস্ত ইংরেজি আর ট্যাঁশ বাংলা, খচাখচ ক্যামেরার আলোর ঝলকানি, লোক-বুঝে-ঝোপ-মেরে-সেলফি নেওয়া এবং সব্বার একে-অপরের প্রতি খুব খুব খুব ভালোবাসা-শ্রদ্ধা ইত্যাদি দেখতে দেখতে মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। এতই মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম যে সবাই যখন আলোচ্য বইটা কিনে সেই খাঁটি সায়েব লেখককে দিয়ে সই-টই করানোর জন্য অটোর লাইনের মত লাইন দি্লেন ( বাজি ফেলে বলতে পারি ভদ্রলোক সায়েব না হলে কেউ লাইন দিয়ে দাঁড়াত না, সব্বাই হুমড়ি খেয়ে গায়ের ওপর পড়ত আগে সই নেওয়ার জন্য), তখনও আমি এদিক ওদিক অন্যান্য বই দেখতে দেখতে ভাবতে থাকলাম যে এই সব ফরাসী সুগন্ধী আর অনর্গল ইংরেজি বুলির সাথে বিচ্ছিরি মিষ্টি দেওয়া কমপ্লিমেন্টারি দুধ-চা আর নোনতা বিস্কুট ঠিক খাপ খায় কি না ! এইসব কারণে আমার আর লেখকের সই নেওয়া হল না, তাই এইসব এত কথা যে লিখলাম, সেগুলি যে সব সত্যি, সেসব প্রমাণ করার সুযোগ নাই। 

যাইহোক, কয়েকদিন পরে আমার সেই বন্ধু জানতে চাইলেন কেমন লাগল তাঁদের অনুষ্ঠান। আমি মনো্যোগ দিয়ে বই-এর আলোচনা এবং লেখক ছাড়া আরোও এত কিছু পর্যবেক্ষন করেছি জেনে খুবই দুঃখিত হলেন, এবং নিশ্চিত হলেন যে তিনি আমন্ত্রণ পত্রগুলির মধ্যে অন্তত একটিকে গঙ্গায় ভাসিয়েছিলেন। তিনি এখন আর আমার মত তরলমতী সাহিত্যানুরাগীকে এইসব গুরুগম্ভীর অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য চিঠি বা বার্তা পাঠান না।

কী আর করা যাবে, যার যা অভ্যেস ! এই সপ্তাহে অনেকদিন পর একটা ফিল্ম দেখতে গেলাম। 'জগ্‌গা জাসুস' । ফিল্ম যত না দেখলাম, তার থেকে বেশি আশেপাশের বহুবিধ জিনিষ এবং বিষয় দেখলাম। ফিল্ম দেখতে কার না ভালো লাগে? সবার মত আমারও লাগে। তাই সেই কলেজে পড়ার সময় থেকে, সুযোগ পেলেই ফিল্ম দেখতাম। ইশকুলে পড়ার সময়ে বাড়ির কড়া শাসনে সেসববের কোন সুযোগই ছিল না। কলেজে উঠে একে হোস্টেল বাস, তায় নাকের ডগায় হাতিবাগান চত্বর। তাই শনিবার বা রবিবারের ম্যাটিনি প্রায় বাঁধা। সে যে হলই হোক, যে নায়ক-নায়িকাই হোক। বেশিরভাগই হিন্দি, মাঝেমধ্যে ইংরেজি- তখন নিউ-মার্কেট চত্বর; কলেজে পড়াকালীন হলে গিয়ে বাংলা ফিল্ম দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। সুধী পাঠক, এই অবধি পড়ে দয়া করে অধুনা প্রচলিত বিবিধ বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধমক এবং/অথবা গালাগালি না দিলেই বাধিত হব। কেন তখন বাংলা ফিল্ম হলে গিয়ে দেখতাম না, বা দেখার সুযোগ হয়নি, সে বিষয়ে আলাদা করে একটা বিশ্লেষণী পোস্ট কোন চলচ্চিত্রবিদ্যার গবেষক আমার থেকে অনেক ভালো দিতে পারবেন।

যাইহোক, সেই সময়ে মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে, এরপর থেকে নিয়ম করে, বিশেষ করে চাকরি-টাকরি পেলে, প্রতি সপ্তাহে একখানা করে ফিল্ম দেখব। শনিবার বা রবিবারে বিকেলে, ফুরফুরে মেজাজে, বাদামভাজা খেতে খেতে, মাঝেমধ্যে ছারপোকার কামড়ও খেতে খেতে...কিন্তু ফিল্ম দেখতেই হবে, নইলে জীবন বৃথা। কিন্তু এ জীবনে ক'টা জিনিষই বা পরিকল্পনা মাফিক হয়? ইউনিভার্সিটির ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে প্রতি সপ্তাহে নন্দন চত্বরে দেখা করে বন্ধুরা একসাথে সিনেমা -নাটক-বই নিয়ে আলোচনা করে করে সবকিছুকে উলটে পাল্টে দেব, প্রতি মাসে মাইনে পেয়ে একটা করে নতুন বই (আর নতুন জামাও )কিনব, এহেন কত পরিকল্পনাই তো করা হয় (আগে কোনদিন ভাবিনি, এখন লিখতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছি পরিকল্পনা শব্দটার মধ্যেই 'কল্পনা' শব্দটা আছে...অগত্যা...)- কিন্তু জীবন নামক এই অপরিকল্পিত রোলার কোস্টার রাইডের দৌলতে আরো অনেক কিছুর মতই সে সবের বেশিরভাগটাই শুধুই কল্পনা থেকে গেল। তারপরে একাধিক বিষন্ন বিকেলে একে একে আবিষ্কার করলাম, প্রিয় সিনেমাহলগুলো কেমন বন্ধ হয়ে গিয়ে, ভাঙা পড়ে দোকান বা বহুতল হয়ে গেছে, তাদের বদলে মাল্টিপ্লেক্স নামক অত্যাশ্চর্য সিনেমা ঘর এসে গেছে, সেখানে ফিল্মের টিকিট আর ব্ল্যাকে বিকোয় না, একেকটা টিকিটের দামে আমার এক সপ্তাহের তরি-তরকারি কেনা যেতে পারে, জল খেতে গেলেও দ্বিগুন দাম দিয়ে বোতল কিনতে হয়, কতগুলি রোগা রোগা ছেলেমেয়ে শুকনো মুখে ইউনিফর্ম পরে জো হুজুর, জী হুজুর করতে বাধ্য হয়, অবাস্তব দামে চিরপরিচিত 'ভুট্টার খই' কিনে- আমার দাদু ছোটবেলায় বাজার থেকে গরম গরম ভাজা কিনে এনে দিতেন- 'পপকর্ন' নামে খাচ্ছি বলে সুখ অনুভব করতে হয়...

শুনেছি ( এবার আইনক্সের বিজ্ঞাপনেও দেখলাম) তাদের কোন কোন হলে কর্মীদের পোষাক ডিজাইন করেছেন বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার, খাবার তৈরি হচ্ছে বিদেশ ফেরত শেফের নিজস্ব রেসিপিতে, দর্শকদের নিজস্ব বাটলারও পাওয়া যায় ! তিন ঘন্টার ফিল্ম দেখতে গিয়ে মাঝে একখানা বাটলারের কী প্রয়োজন বুঝলাম না। অবিশ্যি আমি প্রায় মুখ্যু মনিষ্যি , তায় মেয়েমানুষ , আমি বাংলা মেগাসিরিয়ালও বেজায় মন দিয়ে দেখি, ফিল্ম দেখতে বসলে, বিশেষতঃ প্রথমবার, সেটাকে আরো বেশি মনোযোগ দিয়ে দেখতে, বুঝতে যাই। ওইটুকুই আমার 'ক্যাপা'। তাই তিন ঘন্টার মহার্ঘ privilege of over-consumption এর ক্ষমতার মাধুর্য বোঝা আমার কম্মো নয় !

শেষ মাল্টিপ্লেক্সে ঢুকেছিলাম ২০১৩ তে। ‘চাঁদের পাহাড়’; কোন এক হলে বিকেল বেলাও ৮০ টাকার টিকিট দিয়েছিল, তাই সস্তায় আফ্রিকা ভ্রমণ করতে গিয়েছিলাম। তারপরে কী হয়েছিল, সে শ্যামলাল সহ সবাই জানে। চার বছর পরে আইনক্সে ঢুকে প্রথমেই নজরে পড়ল ভুট্টার খইয়ের দাম আরোও বেড়ে গেছে। টিকিটের দাম ১১৮ টাকা। খইয়ের 'বাকেট' ১৮০ টাকা থেকে শুরু। 'খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি' বলতে ঠিক কী বোঝায়, আরেকবার বুঝলাম। আগে পপকর্ণ মোটামুটি ভদ্রসভ্য একটা বড় কাপে দিত। তার বদলে এতবড় কাগজের বালতি ভর্তি পপকর্ণ কারা খেতে চেয়েছিল কে জানে ! লোকজন হলে ঢুকছে, কাঁখে একখানা বালতি ভরা ভুট্টার খই ! দেখেও সুখ ! আমরা অবশ্যি চাপ নিলাম না। আগেই বলেছি, নিম্নগামী- মধ্যবিত্ত। বাইরে থেকে ত্রিশ টাকার এগ রোল সাঁটিয়ে ঢুকেছি বস ! তিন ঘন্টার জন্য পেট ফুল, মাইন্ড কুল। যাদবপুরের ফিল্ম স্টাডিজের কিশলয়দাকে মনে পড়ে গেল। ব্যয় সংকোচনের এক ক্লাসিক টিপ দিয়েছিলেন- বিকেলের দিকে ক্যান্টিন/দোকান থেকে দুটো ঠাণ্ডা সিঙারা কিনে খেয়েই এক গ্লাস জল খেয়ে নেবে। ব্যস। অবধারিত অ্যাসিড, গ্যাস, পেট ফুলে বোম ! সারা সন্ধ্যা আর কিছু খেতেই ইচ্ছে করবে না। রাত দশটা অবধি পেট ভরতি গ্যারান্টিড। কেমন চাট্টি পয়সা বেঁচে গেল !

( আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই লিখেছি ওপরে। একটা টিপ; একাধিক টিপ্‌স্‌ ; একটা জোক। একাধিক জোক্‌স্‌ " আমি তোমাকে একটা টিপ্‌স্‌ দিচ্ছি" বা " আমি একটা জোক্‌স্‌ বলছি" বললে সেটা অতি গোলমেলে এক ব্যাপার ।)

তারপরে তো হলে ঢুকে নিজেদের সীট খুঁজে বসা হল। বিজ্ঞাপন শুরু হল। অমনি আমার সঙ্গম বিউটি পার্লারের কথা মনে পড়ে গেল। কেন মনে পড়ে গেল, সেটা যাঁরা নব্বইয়ের দশকে নিয়মিত সিনেমাহলে যেতেন তাঁরা বুঝবেন। আহারে... স্ক্রীনে কোন সুন্দরী ফেশিয়াল করতেন কিংবা কনে সাজতেন, আর সারা হলের সব ছেলে এক সাথে গেয়ে উঠত সেই অমর সঙ্গীত...'স্যাংগ্যাম ইজ দ্য নেম '! কোথায় গেল সেদিনের সেইসব সোনাঝরা সন্ধ্যা !কিন্তু ও নিয়ে আর ভেবে কী হবে- যাক, যা গেছে তা যাক ! তাপ্পরে দেখলাম সব্বাই খুব পরিবেশ সচেতন আর দেশ প্রেমী হয়ে উঠেছে- গাছ লাগাও, পোলিও খাওয়াও, জি এস টি কত্ত ভালো , বিদ্যুৎ বাঁচাও, প্লাস্টিক হঠাও, ইত্যাদি সব এসে গেল ফিল্ম শুরু হওয়ার আগে। 

শুরু হল জাতীয় সঙ্গীত। আদর্শ দেশবাসীর মত সবার সাথে উঠে দাঁড়ালাম। না দাঁড়ালে বিশেষ কিছু হয়ত হত না, হলের ৩০% ও ভর্তি ছিল না। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আবার ব্যাপারটাকে নিয়ে আমি কত বড় দেশদ্রোহী প্রমাণ করার জন্য বাকি তিন ঘন্টা লেবু কচলানোর দায়িত্ব নিতে পারেন, এবং আমার ফিল্ম দেখার বারোটা বাজাতে পারেন। পয়সা খরচা করে বিরক্ত হতে আমি উৎসাহী নই। তাই চাপ নিলাম না। গানটা অতি বাজে ভাবে গাওয়া, এবং স্ক্রীন জুড়ে ডিজিটাল তেরঙ্গা। পতাকাটা আসল পতাকার ছবি হলে দেখতে ভালো হত।

এরপর ছবি। 'জগ্‌গা জাসুস' বিষয়ে বলা খুব কঠিন। এতদিনে তো ইন্টারনেটে, কাগজে, ব্যক্তিগত পোস্ট এ সবরকমের আলোচনা-সমালোচনা পড়ে সবার ধারণা হয়েই গেছে এই ছবি কেমন। আমার দেখে মনে হয়েছে অনুরাগ বসু একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন- শুধু মাত্র প্রথম ভারতীয় মিউজিক্যাল বানানোর চেষ্টা বা কমিক-বুকের অনুকরণে ফ্রেমিং ইত্যাদির জন্যই নয়; 'জগগা জাসুস' আসলে আন্তর্জাতিক স্তরের প্রযুক্তিগত নির্মাণপদ্ধতি ব্যবহার করে হিন্দি ভাষায় তৈরি করা এক আদ্যন্ত বাঙালি এবং পূর্বভারতীয় ছবি।এই ছবি দেখাল মুম্বই, দিল্লি, ব্যাঙ্গালো্রের নগরদৃশ্য কিংবা ইউরোপের নিসর্গকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়েও শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গ এবং উত্তর পূর্ব ভারতকেও ( এবং সম্ভবত খানিকটা থাইল্যান্ড) যথেষ্ট 'এক্সোটিক' করে দেখানো যায়; সাথে আফ্রিকা তো আছেই। ঘটনাক্রমের পশ্চাৎপটে নৃত্য থাকলেই সেগুলি ভাংড়া, গরবা কিংবা লাভ্‌নি হওয়ার প্রয়োজন নেই। আর শত্রু মানেই পাকিস্থান নয়। এর বাইরে বাকি ছবিটা জুড়ে 'মঙ্গলবার জঙ্গল সাফ করার দিন...' থেকে শুরু করে 'শুন্ডি' হয়ে আকাশ থেকে মন্ডা-মিঠাই পড়া অবধি পরতে পরতে এক শ্রেণির বাঙালি নস্টালজিয়া জড়িত। মুশকিল হল, আপনি যদি বাঙালি না হন, কিংবা প্রবাসী বাঙালি হন, যিনি কোনদিন বা বহুদিন বাংলা বই পড়েননি বা কিছু বিশেষ বাংলা ফিল্ম দেখেননি , তাহলে এইসব সূক্ষ্ম কৌতুকপূর্ণ মূহুর্তগুলিকে উপভোগ করার সুযোগ নেই। অবশ্য আপনি আদ্যোপান্ত বঙ্গবাসী বাঙালি হয়েও এইসব না বুঝতে পারেন। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ, পৃথিবীর সব বাঙালিকে কেউ মাথার দিব্যি দেয়নি রবীন্দ্রনাথ থেকে সত্যজিৎ, টিনটিন থেকে ফেলুদা- 'শিক্ষিত বাঙালির' প্রমিতীকরণ মেনে সব পড়ে ফেলতে হবে, দেখে ফেলতে হবে এবং মনে রাখতে হবে, ফিল্ম দেখতে গিয়ে ক্রস-কালচারাল রেফারেন্স খুঁজতে হবে, সূক্ষ্ম কৌতুকরসের সাথে ভাঁড়ামো এবং ছ্যাবলামির তফাৎ জানতে হবে, কোন সময়ে হ্যা হ্যা করে হাসতে হয়, আর কোন সময়ে চোখের কোণের জলে মিশে থাকে চাপা আনন্দ- সেটা অনুভব করতে হবে !

কিন্তু এইসব নস্টালজিয়া এবং 'শিক্ষিত' দর্শক হিসাবে প্রত্যাশিত আংশিক আঁতলামোর সুযোগ বাদ দিয়ে, এই ফিল্মে টানটান গোছানো গল্প, বা চিত্রনাট্য খুঁজতে গেলে হতাশ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ এই ফিল্মে কোন একটা গল্প নেই। একাধিক গল্প আছে। এত বেশি গল্প আছে যে শেষে গিয়ে পরিচালক নিজেই খেই হারিয়ে ফেলেছেন। অনেকগুলো ছড়ানো সুতো আর গোটানো হয়নি। ফলে ফিল্মের শেষটা যথেষ্ট ঘাঁটা। আরেকটু গুছিয়ে, সব সুতোর জট ছাড়িয়ে দেখালে বেশি খুশি হতাম।এবং এই কারণেই সম্ভবতঃ অনুরাগ বসুর প্রায় পঞ্চবার্ষিকী পরিশ্রমটা অনেকটাই মাঠে মারা যাচ্ছে। 

আজকাল কোন ফিল্মই মনে হয়না টাকাপয়সা ফিরে পাওয়ার দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর টাকা ফিরে পেলেই ফিল্ম সফল হয়। শুনলাম ১০০ কোটি টাকার ওপর খরচা হয়েছে এই ছবি বানাতে। আশাকরি নির্মাতারা সেই টাকা সব ফিরে পাবেন।

তবে একটা কথা, আপনার যদি মনে হয় ফিল্মটি দেখতে যাবেন, তাহলে একটাই অনুরোধ- দয়া করে মন দিয়ে পরপর চলতে থাকা গান/ গানের মধ্যে কথোপোকথনগুলিকে উপেক্ষা করে সেই সময়ে ফেসবুকে বন্ধুদের সেলফিতে লাইক দেওয়া থেকে, কিংবা খিস্তি সহযোগে ফোন রিসিভ করা থেকে বিরত থাকুন। এই ছবি মিউজিক্যাল ঘরানার, তাই এই ছবিতে গানই কথা বলে (ইউটিউব ট্রেইলারে দেখা গানগুলো বাদ দিয়ে)। গানগুলিকে মন দিয়ে অনুধাবন না করলে কিন্তু পুরো ব্যপারটাই বেজায় গুলিয়ে যাবে। এই ধরনের ফিল্ম দেখতে ভারতীয়রা খুব একটা অভ্যস্ত নন। কিন্তু তাতে কী? নতুন কত কিছুতেই তো রোজ অভ্যস্ত হচ্ছেন। এতেও নাহয় হলেন।

ঘন্টা তিনেক পরে বৃষ্টিভেজা হাওয়ায় বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হল, অনুরাগ বসুর শরীর কেমন আছে? উনি বহুবছর ধরে যে মারণ ব্যাধির সাথে লড়াই চালাচ্ছেন, তার সাথে হারজিতের সমীকরণটা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে এখন? কেন জানিনা মনে হচ্ছিল, অনুরাগ বসু দুনিয়ার সবাইকে জানিয়ে দিতে চাইছেন তিনি ঠিক কেমন দুনিয়া পছন্দ করেন, কাদের কথা বলতে চান, এই দুনিয়া বিষয়ে তার মতামত কী...খানিকটা সত্যজিতের 'আগন্তুক'-এর মত। আমি ভুলও ভেবে থাকতে পারি অবশ্য। ছবিটাতে অনুরাগ সবথেকে যে সাহসী কাজটা করেছেন, সেটা ইদানীংকালে আর কোন হিন্দি ছবিতে হয়েছে বলে জানিনা ( অন্য আঞ্চলিক ভাষার দুর্দান্ত সব ছবি দেখার সুযোগ নাই আর বাংলায় হয় নাই)। এই ছবিতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে গানে-গল্পে তুলে এনেছেন এই সময়ের জ্বলন্ত সব প্রশ্ন ও সমস্যাগুলি- মৌলবাদ, যুদ্ধের রাজনীতি, মানুষে মানুষে লড়িয়ে দেওয়ার ব্যবসা- অনেক কিছু। আমাদের শৈশব-কৈশোরে হয়ত এইসব বিষয়ে জানা খুব জরুরী ছিল না। কিন্তু আজকের বদলে যাওয়া দুনিয়ায় ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সামনে রোজ ব্যবহার হওয়া এই শব্দগুলিকে নিয়ে খোলাখুলি, স্বচ্ছ আলোচনার সময় হয়ত সত্যিই এসে গেছে- সেটা যদি 'জগগা জাসুস' নামের এক আধাখ্যাঁচড়া 'মিউজিক্যাল স্পাই রোমান্টিক কমেডি থ্রিলার ' শুরু করে, তাতেই বা ক্ষতি কী? 

যে দেশের গরীব মানুষের পরনে কাপড় নেই, পেটে দুবেলা ভাত জোটেনা, তাদের হাতে আন্তর্জাতিক মানের দামী অস্ত্র আসে কোথা থেকে?- এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে এটাও বোঝা যাবে এক অপ্রয়োজনে বিশাল ঠোঙ্গা ভরা কাঠখোলায় ভাজা ভুট্টার দানা ১৮০ টাকায় কিনতে কেন একজন দর্শক বাধ্য হবে।

পরিশেষে, 'জগ্‌গা জাসুস'-এর মতই খানিকটা, এই আগাপাশতলা খিচুড়ি পোস্টটাকে আপনার মূল্যবান সময় ব্যয় করে শেষ অবধি পড়লেন - এহেন 'গলতি সে মিস্‌টেক' করার জন্য সুধী পাঠক, আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।