আমাদের পাড়ার বাইপাসের মোড়ে, বাইপাসের ধার ঘেঁষে একখানা লম্বা পুকুর। সেটির এক পাশ দিয়ে, আমাদের পাড়ায় ঢোকার রাস্তার ধারে ঠাকুর ভাসান দেওয়ার স্থায়ী ঘাট। এই অঞ্চলের এবং সংলগ্ন এলাকাগুলির যাবতীয় বড়, মেজো, ছোট ঠাকুর এখানেই ভাসান হয়। পাশেই দমকল স্টেশন। বুঝেশুনেই ভাসানের জায়গা করা হয়েছে !

আজ মোড়ে ঠাকুর ভাসানের জন্য বেজায় ভীড়। তার মধ্যেই কারা যেন খিচুড়ি প্রসাদ বিলি করছে, কেউ কেউ খুব মন দিয়ে তাই খাচ্ছে। তার থেকেও বেশি মন দিয়ে আইসক্রীম, ফুচকা, চাউমিন, মোমো ইত্যাদি খেয়ে চলেছে আরোও লোকজন। নানা মাপের ম্যাটাডোরে নানা মাপের কালীমাতা ঠাকুরানি সিঁদুর লেপিত সন্তান-সন্ততি সহ আবির্ভূত হচ্ছেন। দুম দাম চকোলেট বোমা ফাটছে। মধ্যেখানে হঠাৎ ট্যাং ট্যাং করে ঘন্টা বাজিয়ে দৌড় দিল একখানা দমকলগাড়ি- কোথায় আবার আগুন লাগল কে জানে ! দমকল স্টেশনের উল্টোদিকে পাড়ার সব থেকে বড় মা এখনও ডায়াস ছেড়ে নামার চেষ্টাই করেন নি, শেষ রাতে নামবেন মনে হয়। তাঁর সামনে দলবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে তাঁর সুসজ্জিত সন্তান-সন্ততিরা তাঁকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে গ্রুপি তুলছেন। সব মিলিয়ে মেলাই মেলা আর কী !

এরই মধ্যে আমার মত মায়ের পাপী-তাপী সন্তানেরা তিন দিন বৃষ্টি বাদলার পর বাজার করতে বেরিয়েছেন এবং আশি টাকার বাসি পটল কেনা উচিত, নাকি কুড়ি টাকায় কুঁডি- স্বরূপ ফুলকপি কেনাটা ঠিক হবে গোছের তুশ্চু জাগতিক ভাবনায় চিন্তায় লিপ্ত। এই অবধি পড়ে যদি বলেন - সারাদিন খালি খাই খাই, আমি বলব - 'সকলি তোমারি ইচ্ছা...তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি...' ...হুঁ হুঁ বাওয়া, আমার কোনও দোষ নাই...মা চাইলেই ভাসান ড্যান্সে নাচতে চলে যেতাম; মা চাননি, তাই লক্ষ্মী মেয়ের মত কলাটা-মূলোটা কিনে বাড়ি ফিরে এলাম।

কলাটা মূলোটা কিনতে কিনতে শুনি, পাড়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে পাশ দিয়ে একখানা গাড়ি বেজায় হাঁকতে হাঁকতে যাচ্ছে, - এবার আমাদের ঠাকুর বেরোবে, এবার আমাদের প্রতিমা নিরঞ্জনের পথে বেরোবে...শুনে ভাবলাম এ আবার এমন কী প্রয়োজনীয় ঘোষণা ? যাবি তো বাপু পাড়ার মধ্যে থেকে বেরিয়ে মোড় অবধি, তার আবার এত ঘ্যাম কীসের?

ব্যাপারটা অবশ্য একটু পরেই পরিষ্কার হল... আমার পাড়ার প্রধান সোজা রাস্তাটার থেকে পরপর গোটা পাঁচেক রাস্তা সমকোণে ( জ্যামিতির ভাষায় বললে উল্লম্ব ভাবে) ঢুকে গেছে পাড়ার ভেতর। সেই রাস্তাগুলির মধ্যে তিনটি থেকে একই সঙ্গে তিনজন মা তাঁদের স্বীয় সন্তান-সন্ততি সহ ধীরে ধীরে নিরঞ্জনের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওরই মধ্যে কোনও একটা রাস্তার সন্তানদল ' বেরোচ্ছে বেরোচ্ছে' টা করে আসলে অন্য দুই দলকে একটু চাপ দিল আর কী । ( আমারই পাড়ায় তিনটে পুজো, কিন্তু আমার সেগুলির সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই - এর থেকেই বোঝা যায় আমি ঠিক কতটা সামাজিক প্রাণী ) তা, নিরঞ্জনের প্রস্তুতি স্বরূপ তাসা পার্টির বাদ্যযন্ত্রেরা এক গলি্তে ' আরে দিওয়ানো মুঝে পেহচানো...', পরেরটা তে 'নাগিন নাগিন', আর শেষেরটাতে 'সাত সমুন্দর পার ম্যায় তেরে পিছে পিছে আ গয়ী...'র গিটকিরি- গমক শুরু করেছে। এই ব্যাপারটা যে কী ভালো, বলে বোঝানোর নয়। আজ্ঞে হ্যাঁ, আমিই এই শেষের বাক্যিটা লিখেছি, যদি জানি পুরো ব্যাপারটায় বেজায় শব্দ দূষণ হয়, আর পাশের আবাসন থেকে ঠাকুর বিসর্জন দেওয়ার সময়ে আমার জানলার নিচে পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে বাজালে আমারই মনে হয় সব ব্যাটাকে গিয়ে 'নীল ডাউন' করিয়ে আসি; তবুও, মানো ইয়া না মানো, তাসা পার্টি না থাকলে ঠাকুর বিসর্জন বৃথা ।

প্লীজ প্লীজ, এখন কেউ আমাকে 'বাংলার সংস্কৃতির বিরোধী ' বলে বকবেন না; আজকাল প্রাণ খুলে কোনও কিছুকে ভাল বা খারাপ বলাও খুব চাপের হয়ে গেছে। কোন কথাটা লিখলে যে আমি দেশদ্রোহী, আর কোনটায় রাজ্যদ্রোহী, কোনটায় বাঙালিবিরোধী, কোনটায় ধর্মদ্রোহী, কোনটায় নারীবিরোধী আর কোনটায় পুরুষবিরোধী- খুব ভয়ে থাকি ( রোজই প্যারামিটার বদলাচ্ছে কিনা ) - . তবে কিনা আগেই বলেছি - 'তোমার কর্ম তুমি কর মা, লোকে বলে করি আমি'...মা যা লিখিয়ে নিচ্ছেন, আমি তাই-ই লিখছি।

যাইহোক, যেখানে ছিলাম...এই তাসা পার্টিতে যত গান বাজানো হয়, তার মধ্যে বাংলা গান এত কম কেন কে জানে ! সেই জন্মে থেকে যে গান গুলি শুনে আসছি, তার সঙ্গে নতুন যে সব গান ঢুকেছে, তার মধ্যেও হিন্দি গানের সংখ্যাই বেশি। নতুন বাংলা গান বলতে দুর্গাপুজোর সময়ে শুনি 'ঢাকের তালে কোমর দোলে...' আর ' পাল্কি তে বৌ চলে যায়...' । মাঝেমধ্যে দু-একটা আরোও জিৎ গাঙ্গুলি থাকে অবশ্য। কিন্তু তা বাদে? এই এখনও শুনতে পাচ্ছি সেই ' ম্যায় হুঁ ডন ... !' বেজে চলেছে। জিৎ গাঙ্গুলির উচিত এ বিষয়ে আরোও ভাবনা চিন্তা করা। অনুপম রায় কিংবা জয় সরকার মশাইয়ের কম্মো নয় এটা।

বাই দ্য ওয়ে, গত কয়েক বছরের কে-জানে-কাদের-দ্বারা-সংশোধিত ফ্যাশন ট্রেন্ড অনুযায়ী এবারেও পাড়ার বড় কালীমাতা দেখলাম একখানা লাল পাড় গরদ পরে দাঁডিয়ে আছেন। আজকাল এই শাড়ি পরা কালী মাকে দেখে মনে হয় - আগেই তো ভালো ছিলেন... শাড়ি তো সব ঠাকুরানীরাই পরেন, ইনিই তো একটু আলাদা ছিলেন, ক্ষতি তো কিছু ছিল না... দুনিয়ার সব মহিলাকে যেমন বিশেষ কন্ডিশনার না কী যেন লাগিয়ে চুল সোজা করতে বলা হচ্ছে, সেইরকম সব দেবীদের সব রূপেই পরনে কাপড় থাকতে হবে, ?

ব্যাপারটা আমার আগেও পোষায়নি, আজও পোষাল না। আমাদের সেই ফেলে আসা, হারিয়ে যাওয়া শৈশবে-কৈশোরে, আমরা সর্বদাই দেখে এসেছি, তিনি কালী রূপেই আসুন কিংবা শ্যামা, তিনি নরমুন্ডের মালা গলায় পরে, আর কটিতে মানুষের কাটা হাতের কটিবাস। তাই দেখে জীবনে অশ্লীলও মনে হয়নি, ভয়ও হয়নি। ভয় না হওয়ার কারণ অবশ্য প্রথমে ছোটবেলায় পড়া উদ্বোধন প্রকাশনের 'ছোটদের রামকৃষ্ণ' আর পরে পান্নালাল ভট্টাচার্য্য মশাই -এর গান। যে ঠাকুর মূর্তি থেকে বেরিয়ে এসে পুজারি রামকৃষ্ণের হাতে অন্ন খেয়ে যান, কিংবা যাঁকে অতি নরম করে সহজেই বলা যায় 'আমি সকল কাজের পাই হে সময়, তোমারে ডাকিতে পাইনে' - তাঁকে খামোখা ভয়ই বা পেতে যাব কেন? কিংবা অশ্লীলই বা ভাবতে যাব কেন? মা কালী এলে কত আনন্দ হত... কেমন আকাশ বাতাস হিম হিম হয়ে যেত... কত কত বাজি ফাটানো যেত, তিরতিরে মোমের আলো আর টিমটিমে প্রদীপের আলোয় সাজানো আলো-আঁধারি মফস্বলের অসমান উঁচু-নীচু জমিতে দাঁড়িয়ে থাকা আবছায়া একতলা-দোতলা বাড়িগুলোকে দূর থেকে দেখে 'রাজকাহিনী'র হাম্বির রাজার কৈলোরের গ্রামবাসীদের দেওয়ালি উৎসবের কথা মনে পড়ত, আরো দূরের কোনও পুজোমন্ডপ থেকে ভেসে আসত পান্নালাল ভট্টাচার্য্যের গান, যেগুলি ছাড়া কালী পুজো ভাবাই যেত না, আমরা রাতের দিকে কান মাথা রুমালে কিংবা টুপিতে ঢেকে লোয়ার কেশিয়ার মাঠে উদয়ন সঙ্ঘের মন্ডপ আর ঠাকুর দেখতে যেতাম...সেই কোন ভুলে-যাওয়া-স্বপ্নের মত অতীতেই উদয়ন সংঘের দাদারা মাঠের মাঝখানে এই অ্যাত্ত বড় মন্ডপ বানাতো, আমরা দেখে হাঁ হয়ে যেতাম...একবার ধবধবে সাদা মন্ডপে নীল আলো লাগিয়েছিল... সে মন্ডপ দেখে আমাদের আর কথা সরছিল না...নীল রঙের ও টুনি লাইট হয় বুঝি? সেই মন্ডপের পাশেই, একই মাঠে, অপেক্ষাকৃত ছোট এক মন্ডপে হত লোয়ার কেশিয়া পুজো কমিটির শ্যামাপুজো...একই চত্বরে দুই রূপে দাঁড়িয়ে থাকতেন একই দেবী.., উদয়ন সংঘের ঘোর কালো, রক্তচক্ষু কালী, যাঁকে দেখে একটু একটু গা শিরশির করত... ধন্ধ হত সেটা কার্তিকের হিমের জন্য কিনা... আর কেশিয়াপল্লীর অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা দেখতে নীলচে ত্বকের শ্যামা... তাঁকে দেখে তো ভয় পাওয়ার কোন কারণই নেই... নাহঃ এর মধ্যে মা কেন শাড়ি পরে নেই- সে নিয়ে চিন্তা করার কোনও জায়গা ছিল না।

এই অবধি পড়ে আবার ভেবে বসবেন না বাপু, আমি হেব্বি ভক্তিমতী , সকাল সন্ধ্যে পাঁজি দেখে উপোস দিয়ে পুজো-আচ্চা করছি। একেবারেই না। আমার সঙ্গে সব ঠাকুরের দাবী-দাওয়ার ব্যক্তিগত বোঝাপড়া আছে। তার মধ্যে সমাজ এবং ধর্ম নির্ধারিত নিয়মকানুনের জায়গা বিশেষ নেই। আর হিন্দু ধর্ম কিংবা ধর্মাচরণ সম্পর্কে যে ধারণা, সেটা পুরোটাই

আগের প্রজন্মের আত্মীয়স্বজনদের এবং কিছু সমবয়সী বেজায় ধার্মিক বন্ধুদের দেখে। আমি জানি, সেই ধারণা 'বাঙালি হিন্দুর ধর্মাচরণ' নামক মহাসমুদ্রের থেকে তুলে নেওয়া কয়েকটি ফোঁটা মাত্র। তবে স্বাভাবিক মানুষের বুদ্ধিতে এটুকু বুঝেছি,সাধারণভাবে বাঙলার/ বাঙালি হিন্দুদের ধর্মাচরণের ভাবনা চিন্তার সম্পর্কে ,কিংবা ঈশ্বর ও ভক্তের সম্পর্ক বিষয়ে ইদানীংকালের হঠাৎ-গজিয়ে-ওঠা-সব-বিষয়ে জ্ঞানগুরু-হওয়া কিছু ইয়ের কোনও সম্যক ধারণাই নেই।

আর লিখব না। বিশ্বাস করুন চাই না করুন, আজ কোনও রকম প্ল্যান প্রোগ্রাম ছাড়াই তিন দিন তুমুল বৃষ্টির পরে, খাদ্যান্বেষনে গিয়ে মন্ডপে মায়ের সঙ্গে মোলাকাত হয়ে গেল। হওয়ার কথাই নয়। আমি তো থোড় -বড়ি-খাড়া বাজার করতে গেছিলাম। আমার তো ধারণা ছিল গতকাল/ গত পরশুই সব ঠাকুর বিসর্জন হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি চাইলেন তাই ইয়াব্বড় লাল জিভ বার করে একগাল হেসে আমাকে দেখা দিলেন।

ঠিক তেমনই, ' তোমার কর্ম তুমি কর মা'-র থিওরি মেনে, এই কার্য-কারণ বিহীন ভাসান-ড্যান্স মার্কা রচনাটা , অকারণে , এবং পুরোপুরি বিনা 'কারণে' লেখা হয়ে গেল।

<

মা কালীর দিব্যি বলছি!