( বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ এটি একটি অতিদীর্ঘ পোস্ট--- বৃষ্টিভেজা রথের দিনের মতই অল্প জল-কাদা মাখা, এবং শুরুতে মুচমুচে হলেও শেষে বাসী পাঁপড়ভাজার মত কিঞ্চিৎ ন্যাতানো। তাই নিজের বহুমূল্য সময় ব্যয় করে যদি পড়েন, এবং পড়ার পরে মনে হয় কোনোভাবে আপনার মন এবং মগজ সংক্রমিত হতে পারে, ভুলে যাবেন না - নিজ নিজ স্যানিটেশন, নিজ নিজ দায়িত্বে। )

আমাদের আবাসনে এ বছরের রথযাত্রার বিকেল বেশ বিষণ্ণ ছিল। অন্যান্য বছরে বিকেল হলেই নানা মাপের রথ, রথের মধ্যে তিন ভাই বোন, তাঁদের সামনে আমের কুচি থেকে নকুলদানা হয়ে সন্দেশ, ফুলের মালা, ধূপের গন্ধ ইত্যাদি মিলেমিশে বেশ হইচই হয়। রথের মালিক-মালকিনেরা নিজেদের মধ্যে অজ্ঞাত কিন্তু বেজায় গুরুত্বপূর্ণ সব কারণে একটু হাতাহাতি, কান্নাকাটিও করে নেন। আবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে, খুচরো পয়সা না দিলেও প্রচুর প্রসাদ প্রাপ্তি হয়। এবছর সেসবের দেখা নেই। করোনার ( মাতা বা বাবা হয়ে গেছেন কি?নিশ্চিত নই ) দাপটে জগন্নাথ -সুভদ্রা-বলরামের খুবই কোণঠাসা পরিস্থিতি।

আমি আর ভাইও ছোটবেলায় রথ সাজিয়ে ঘুরেছি এক দুইবার। কিন্তু সেই রথ সাজিয়ে নকুলদানা বিলি করা তো এক সন্ধ্যের ব্যাপার। আমার কাছে ছোটবেলায় রথের আসল আনন্দ ছিল মেলায় যাওয়া। মেলায় যাওয়ার বিষয়ে মায়ের উৎসাহ ছিল বাবার থেকে বেশি। তাই রথ থেকে উল্টোরথের মধ্যে কোনো একদিন বিকেলে সময় করে, ভালো জামাকাপড় পরে আমি আর ভাই মায়ের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম চিত্তরঞ্জনের ছয়ের পল্লীর কম্যুনিটি হলের মাঠে। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি রথের মেলা সেটাই। চিত্তরঞ্জনে আর কোথাও রথের মেলা হত কিনা বা হয় কিনা সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। আমাদের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ এর কোয়ার্টার থেকে ছয়ের পল্লী হেঁটে যেতে অন্ততপক্ষে আধাঘন্টা তো লাগতই, কিন্তু আমাদের বড় হয়ে ওঠার বেলায় সেসব দূরত্বকে দূর বলে মনে হওয়ার সুযোগ ও ছিল না।

রথের মেলায় যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য অবশ্যই খেলনা কেনা। ওইজন্যই মায়ের সঙ্গে গিয়ে বেশি মজা। মায়ের কাছে আব্‌দার করা অনেক সহজ। তাই মেলায় গিয়ে,রথ দেখে, সম্ভব হলে দড়ি ছুঁয়ে , তারপরেই গন্তব্য সটান খেলনার দোকান। ছোট ছোট, হাতের আঙুল মাপের রঙ-বেরঙ এর প্লাস্টিকের তৈরি , পুতুলের সংসারের প্রয়োজনীয় হরেক সামগ্রীর পাহাড় চোখের সামনে - ফ্রিজ, আলমারি, চেয়ার, টেবিল, ইস্ত্রি , সেলাই মেশিল, জলের জাগ, হাতপাখা, টেলিফোন--- কী নেই সেখানে! একেকটার দাম কীরকম হত মনে নেই আর , হয়ত দুই টাকা বা তিন টাকা।আমার সঙ্গে মায়ের নিজেরও খুব উৎসাহ ছিল এইসব ছোট ছোট জিনিষপত্রের প্রতি। তাই কেনা হত বেশ কিছু। কোনটা কোনটা আমার আছে, কোন জিনিষ এবছরে নতুন, সেসব বেশ হিসেবে থাকত। ভাই মোটামুটি অবধারিতভাবে যেটা কিনত সেটা হচ্ছে জলের গামলায় চক্কর কাটতে থাকা ভটভটি নৌকা। সঙ্গে বোধহয় বন্দুক ও দাবি করত, কিন্তু সেটা জুটত কালীপুজোর সময়ে। এছাড়া বেলুন আর ওই বাঁশের কঞ্চির তৈরি হাওয়া-চরকি ( এটার নাম সত্যিই জানিনা) কেনা হত। তবে রথের মেলায় গিয়ে পাঁপড়ভাজা, বা গজা -নিমকি খাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। বাইরের খাবার, খোলা খাবার খাওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ। তাই চোখের সামনে গরম গরম পাঁপড়ভাজা বা চপ ভাজা হতে দেখলেও, গজা -নিমকির পাহাড় দেখলেও, দাঁড়িয়ে কিনে খেয়েছি বলে একবারও মনে পড়ছে না। বাবার নিষেধ ,মা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। সত্যি কথা বলতে গেলে, আমি আজ অবধি কোনো রথের মেলায় গিয়ে পাঁপড়ভাজা খাইনি, কারণ বড় হয়ে ইস্তক কোনো রথের মেলায় যাওয়ার ইচ্ছে এক আধবার হয়ে থাকলেও, সুযোগ হয়েই ওঠেনি। জীবনের অনেকগুলি না হওয়া কাজের মধ্যে এটাও একটা।

আমার পু্তুলের সংসারের জন্য বাকি শৌখিন জিনিষপত্র কেনা হোক বা না হোক,যে যে বছর মেলায় যেতাম, একটা জিনিষ অবশ্যই কেনা হত। সেটা হল একটা ছোট্ট হাতলওয়ালা বাঁশের কঞ্চির ঝুড়ি ভর্তি মাটির রান্নাবাটির সরঞ্জামের সেট --- অদ্ভূত এক অভ্র মেশানো চিকমিকে বেগুনি-পেঁয়াজি রঙে রাঙানো, মাটির তৈরি হাঁড়ি, কড়াই, উনুন, কলসি ইত্যাদি, সব মিলিয়ে গোটা দশ-বারো পাত্র। খেলনাগুলি পোড়ামাটির ছিল না, ছিল কাঁচামাটির। তৈরি করে বিক্রি করতেন যাঁরা, তাঁরা সম্ভবত রেল শহরের আশেপাশের গ্রামের বাসিন্দা। মেলা থেকে ওই ফুলের সাজির মত দেখতে ঝুড়ি ভর্তি খেলনা কিনে ফিরতে পারাটাই আমার কাছে রথযাত্রার সবথেকে অমলিন স্মৃতি। নতুন খেলনা থেকে এন্তার বেগুনি রঙ উঠে হাতে লাগত; প্রবল উৎসাহে ধুলো-বালির মধ্যে জল মিশিয়ে ঝোল রাঁধতে গিয়ে আবিষ্কার করতাম কড়াই-এর এক দিক কেমন যেন গলে গেছে। তুলনায় আমার লাল প্লাস্টিকের কড়াই, হলুদ প্রেশার কুকার বা সবুজ জলের জাগ ছিল অনেক টেঁকসই। বছরের পর বছর কোনো পরিবর্তন নেই। সেগুলি চীনের প্লাস্টিক ছিল কি? কে জানে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, আমার কাছে কোনো এক সময়ে, টিন এবং মাটি দিয়ে তৈরি , তিনখানা শিং-ওয়ালা একখানা ক্ষুদে উনুন আর একটা মাটির তৈরি , সবুজ-লাল-হলুদ রঙ করা, নিখুঁত মিনিয়েচার জনতা স্টোভও ছিল; হিন্ডালিয়ামের তৈরি নানাবিধ হাঁড়ি-কড়াই-সাঁড়াশি-বিবিধ ধরনের খুন্তি-ঝাঁঝরি---সব ছিল। এইসব উৎকৃষ্ট , আধুনিক, সাংসারিক জিনিষপত্র অবশ্যই পাওয়া যেত অপেক্ষাকৃত শহুরে, কলকাতার কাছাকাছি, চন্দননগরের বাবুরবাজারের দুর্গাপুজোর মেলায়। তাই পুজোর ছুটিত দিন পনেরোর 'পরিযায়ী' আমি, দিদু-কাকা-পিসি-পিসেমশাইদের কাছে আবদার করে সেসব যোগাড় করে ফেলতাম। তবুও, সত্যি সত্যি 'নব' ঘোরানো যায় এমন লাল সিলিন্ডার সহ গ্যাস বার্নারের গর্বিত অধিকারিণী হওয়া সত্ত্বেও, আমার ওই একদিকে গর্ত করা মেটে উনুনটার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল।

বছর বারো-তেরো আগে, চিত্তরঞ্জনের চারের পল্লীর দুর্গাপুজোয়, ঠাকুর দেখে বেরিয়ে আসার সময়ে , মন্ডপ চত্বরের ঝলমলে আলোকবৃত্তের থেকে অনেক দূরে, কম্যুনিটি হলের পাঁচিলের গা ঘেঁষে , আবিষ্কার করলাম এক পসারী বসে রয়েছেন আমার সেই ছোট্টবেলার চিকমিকে বেগুনী খেলনাবাটি নিয়ে। তবে সেই কঞ্চির ঝুড়ির জায়গা নিয়েছে নিম্নমানের প্লাস্টিকের প্যাকেট। দেখে মনটা একটু দমে গেলেও কিনে ফেললাম একটা সেট। কিন্তু বাড়ি এসে সত্যি একটু বেশি করে হতাশ হলাম। কারণ, অল্প আলোয় আগে একটা বিষয় নজরে পড়েনি। দেখলাম, হাঁড়ি,কড়াই ইত্যাদি আগের মত থাকলেও বাতিল হয়েছে সব থেকে জরুরী কিন্তু আমার ছোটবেলার সবথেকে কৌতূহল উদ্রেককারী জিনিষটি- একটি জাঁতা। মানে একটি চ্যাটালো থালার মত জিনিষ, তার ধার দিয়ে ঢেউ খেলানো নকশা থাকত। আর মাঝখানে একটা উঁচু , সরু অংশ। সেটার মধ্যে দিয়ে ঘোরানোর জন্য একটা হাতল। দুটোই মাটির তৈরি। আমাদের আধুনিক জীবনে জাঁতার কোনো জায়গা ছিল না, জাঁতা ব্যবহারের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই ছোট বেলায় যখন কিনে আনতাম, ওটা অমনিই পড়ে থাকত। হয়ত যেমন আজ পড়ে থাকে রান্নাঘরের কোণে শিল আর নোড়া। বড় হয়ে বুঝতে পেরেছিলাম বলেই ভেবেছিলাম হারিয়ে যাওয়ার আগে আবার কিনে রেখে দিই। বুঝলাম দেরি কর ফেলেছি। এমন কত দেরিই যে করছি...যাইহোক, দেখলাম বিক্রেতা মোট জিনিষের সংখ্যা কমান নি। জাঁতার বদলে জায়গা পেয়েছে একটি কাপ ও একটি প্লেট, যেগুলি আমাদের ছোটবেলায় এই সম্ভারে থাকত না। বাড়িতে ছাতু পেষা হোক বা না হোক, সকালের চায়ের অভ্যাস তো ছড়িয়েই গেছে না আমাদের জীবন-জীবিকায়?--- সে দ্রব্যটি যতই চীন থেকে এসে থাকুক না কেন !

এইখানে একটু প্রসঙ্গান্তরে চলে যাই। ইদানীং কয়েকবছর আমাদের পাড়ার নববর্ষের মেলায় দেখেছি, ছোটদের খেলনাবাটির সেট ঝুলছে খেলনার দোকানে --- সেগুলি অবশ্যই চীন থেকে আনা, প্লাস্টিকের, কটকটে গোলাপি রঙের সুদৃশ্য রান্নাবান্নার সরঞ্জাম। তার মধ্যে যে সব বাসনের মিনিয়েচার থাকে, সেগুলি বেশ আন্তর্জাতিকভাবসম্পন্ন। যেটা দেখে আমি অবাক হয়েছি, সেটা হল, ফ্রাইং প্যানের মধ্যে নুড্‌ল্‌স্‌-এর স্টিকার আঁটা, যেন প্যান ভর্তি নুড্‌ল্‌স্‌, লাল সবুজ -সাদা রঙের প্লাস্টিকের পিৎজা এবং পিৎজা কাটার। অনেকবার ভেবেছি, এসব জিনিষ এদেশে তৈরি হয় না কেন? এদেশেই যদি বিক্রি করছে, পিৎজার বদলে অন্তত পুরি-তরকারীর খেলনা তো দিতে পারত, বা ইডলি দোসা। মহামান্য প্রধান সেবক বেশ কিছুবার চীন ভ্রমণ করে এসেও ভাবার সময় পান নি। তারপরে, কুড়িটা মানুষ এক সঙ্গে মরে যাওয়ার পরে আমাদের হঠাৎ করে মনে হতে শুরু করেছে, অনেক হয়েছে- আমরা চীনের জিডিপি টেনে নামিয়ে আনব ফোন থেকে কিছু অ্যাপ আনইন্সটল করে, আর চাইনিজ রেস্তোরাঁ বর্জন করে! ভুলে যাচ্ছি এরসব জায়গাতে চাকরি করে কত কত মানুষ। আর যাঁদের রাস্তায় অস্থায়ী দোকান, তাঁদের তো আমরা কোনোদিনই যথেষ্ট মানুষ বলে গন্য করি না। আমি চাই, আমাদের দেশের ছোটরা আমাদের দেশের খেলনা নিয়েই খেলুক। তাদের খেলনা বাটির সেটেবিদেশি স্টকপটের পরিবর্তে দিশি হাঁড়ি থাকুক, চাউমিনের বদলে চানা বাটোরার স্টিকার আটকানো থাক। কিন্তু রাতারাতি একদিন 'আত্মনির্ভর' হওয়ার মাশুল ঠিক কতজন ভারতবাসীকে আগামি কিছু বছরে, কী কী ভাবে দিতে হবে, সেটা ভবিষ্যতই আমাদের জানাবে।

রথের মেলায় দিয়ে শুরু করে কি রান্নাঘর হয়ে চীনে চলে যাচ্ছি? দিব্যি আহ্লাদে ছোটবেলার গল্প করছিলাম, কিন্তু মাঝে মাঝেই কি নিজের ভাবনাচিন্তার নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘন করে অকারণে জটিল পথে পা দিচ্ছি ? কী করা যাবে, নিজের জীবনরেখার ঠিক মাঝবরাবর বা একটু এপাশ-ওপাশে (অপার আত্মবিশ্বাস না হলে এই অতিমারির বাজারে এমন কথা কে বলে! ) দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছি - পুরো জীবনটার বোধ হয় সবটাই নিয়ন্ত্রণ করছে 'পাপী পেট' । আশেপাশে যা ঘটেছে, যা ঘটছে, যা ঘটবে, সবেতেই ঘুরে ফিরে এসেছে, আসছে আর আসবে পাপী পেট কা সওয়াল। যখন যেটুকু লিখি, তার রসদ তো জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই খুঁজে পাই। আর গত তিন মাসে, বাধ্যতামূলক গৃহবন্দীত্বের ( সেই 'প্রিভিলেজ' আছে বলেই থাকতে পেরেছি) মধ্যে থেকে এই ফেসবুকে সবথেকে বেশি যে বিষয়ে আলোচনা , বক্তব্য, অভিজ্ঞতা ভাগ, লেখালিখি হল, ছবি শেয়ার হল সেটা কি খাবার নিয়েই নয়? জীবনে প্রথমবার রান্না করা বিরিয়ানি থেকে শুরু করে ডালগোনা কফি হয়ে শ্রমিক ট্রেনের ক্যারিব্যাগে পুঁটলি করা মুখে দেওয়ার অযোগ্য ডাল-চাওল থেকে রেল লাইনে পড়ে থাকা রক্তমাখা সুগোল রুটির দল পেরিয়ে সেল্ব্রিটি কিচেনের ভিগান স্ট্যু হয়ে আম্ফান বিধ্বস্ত সুদূর গ্রামে পৌঁছানো চাল-ডাল-সয়াবড়ির হিসেব --- আমাদের করোনা-কবলিত দমবন্ধ জীবনের প্রতিটি দিনের পরতেপরতে ছড়িয়ে রয়েছে শুধুই খাবারের গল্প, শুধুই পেট ভরানোর গল্প, কিংবা না বলা যত খিদে-না-মেটার, তৃষ্ণা-না-মেটার গল্প। মানুষ মঙ্গলে পৌঁছাতে পেরেছে, চাঁদে বেড়াতে গেল বলে, প্রবল বিধ্বংসী অস্ত্রশস্ত্র বানিয়ে একে অপরকে হামেশাই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় হুমকি দিচ্ছে, কিন্তু 'বটিকা ইন্ডিকা' আজও কল্পনাই থেকে গেল। যদি বিজ্ঞানীসমাজ এমন কোনো অদ্ভূত ওষুধ সত্যিই তৈরি করতে পারতেন, তাহলে হয়ত গত তিন মাসে যত যত খিদের ছবি চোখের সামনে এল, সেগুলি আমাদের দেখতে হত না। শের শাহ যখন জি টি রোড বানিয়েছিলেন, তখন নাকি পুরো রাস্তার দৈর্ঘ্য জুড়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব বরাবর দূরপাল্লার যাত্রীদের জন্য সরাইখানা থাকত। সেখানে এমন কী ঘোড়াদেরও যত্ন আত্তি করা হত। অবশ্য এই সব কথা আমি ইতিহাস বইতে পড়েছি, অনেক কাল আগে, এবং সে সব ইতিহাস বই নির্ঘাত নেহ্‌রুর নির্দেশেই লিখিত; তার ওপরে আবার একজন মুসলমান শাসকের বিষয়ে লেখা --- তাই এই তথ্য বোধহয় পুরোটাই মিথ্যে। তাই শের শাহ -এর নাম নিয়ে কাজ নেই। বরং আজকের দিনে ভারতবর্ষে এমন কিছু ভাবা যায় কিনা, সেটা দেশের প্রধান সেবক এবং তাঁর পারিষদেরা ভেবে দেখতে পারেন।

গত কয়েক মাসে, পৃথিবীর সমস্ত প্রান্ত থেকে, বারবার ঘুরে ঘুরে যাঁদের কথা সবার মুখে ফিরেছে, তাঁরা হলে শিখধর্মী মানুষজন। পৃথিবীর যে কোনো জায়গাতে, যেখানেই মানুষের খাবারের অভাব দেখা দিয়েছে, শয়ে শয়ে মানুষের মুখে খাবার যোগাতে হয়েছে, অমনিই এঁরা হাঁড়ি, কড়াই নিয়ে লঙ্গর খুলে বসেছেন। এঁদের অভিজ্ঞতার সাহায্য নিয়ে কি ভারতের সমস্ত মহাসড়কের ওপরে , নির্দিষ্ট দূরত্বে, সরকারি লঙ্গরখানা খোলা যেত না? গত তিন মাসের অভিজ্ঞতার পরেও কি এমন কথা ভাব যায় না?

কিংবা শিখেদেরও খামোখা টেনে এনে কাজ নেই, ওরা যথেষ্ট আত্মনির্ভর নয়, ওদের লঙ্গরখানায় একটা যন্ত্র থেকে একবারে একশোটা রুটি বের করে, যে যন্ত্র চীনের না হলেও জার্মানির হতেই পারে। বরং হাতের কাছেই রয়েছে একেবারে ১০০% দিশী উদাহরণ - পুরীর জগন্নাথদেবের মন্দিরের রান্নাঘর। সেখানেই রথযাত্রার সময়ে একেকদিনে লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য রান্না হয়। কাঠের জ্বালে, মাটির পাত্রে, এবং যতদূর বুঝেছি, একাধিক মিথের আড়ালে, যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মতভাবে রান্না হয়। অলৌকিকতাকে সরিয়ে রেখে, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই রান্নাঘরের ধাঁচে কি দেশজুড়ে রাষ্ট্রের দায়িত্বে ছোট ছোট কমিউনিটি কিচেনের পরিকল্পনা করা যায় না? যা আগামি কয়েক বছর অন্তত আমাদের দেশের অন্তত বেশিরভাগ মানুষের পেট দুবেলা ভরানোর দায়িত্ব নেবে? কমিউনিটি কিচেন তৈরি করে মানুষের পেটে ভাত জোগানো কি শুধুই দেশের সাধারণ নাগরিকদের কাজ? জগন্নাথদেব তো সারা জগতের নাথ, তাই এই করোনার বাজারে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে অন্তত হাজার দুয়েক মানুষ মিলে তাঁর রথ টানাকে তিনি কতটা করুণার চোখে দেখছেন জানিনা, তবে জগতের হিতকল্পে তাঁর রান্নাঘরকে প্রোটোটাইপ করলে তিনি খুশিই হবেন।

তিন ভাইবোনের রথযাত্রার গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, শেষ ও করি তিন ভাই বোনকে দিয়ে। এই বিষয়টা নিশ্চয় অনেকেই জানেন, তবুও প্রাসঙ্গিক বলে টেনে আনা। বলরাম-সুভদ্রা-জগন্নাথের ছবি পাশাপাশি মন দিয়ে দেখুন। নৃতত্ববিদদের একাংশের মতে, এই তিন ভাই বোন তিন ধরনের racial group , বা তিন ধরনের মানব জাতির / মহাজাতির প্রতিনিধিত্ব করেন - শ্বেতবর্ণ বলরাম ককেশীয় বা ইয়োরোপীয়দের,পীতবর্ণা সুভদ্রা মঙ্গোলয়েডদের, আর কৃষ্ণবর্ণ জগন্নাথ নিগ্রোয়েডদের। শুধু গায়ের রং না, তিন জনের চোখের আকৃতিও তিন রকমের। এই বিষয়ে প্রথম জেনেছিলাম ঋতুপর্ণ ঘোষের 'ফার্স্ট পার্সন' এর কোনো এক সংখ্যায়। তাঁর মত সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি নৃতত্ববিদ্যায় পারদর্শীও নই। তবে অনলাইনে এই বিষয়ে কন্টেন্ট আছে। আমার মনে হয়েছে, উত্তর -পশ্চিম ভারত, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং দক্ষিণ ভারতের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই এই ভাবনার প্রয়োগ হয়েছিল। সত্যিই এই তিন আলাদা আলাদা চেহারার বৈশিষ্টযুক্ত দেবদেবীকে ভাই বোন বানাল কারা এবং কেন, পুজো-আর্চার বিশদ নিয়মকানুনের পাশাপাশি সে বিষয়ে ভাবা বোধহয় আজকের দিনে আরও জরুরী হয়ে পড়েছে। কারণ যদি এই নৃতাত্বিক তত্ব মেনে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে ভাইবোন ধরে সাত দিন ধরে হইহুল্লোড় করতে চাই, তাহলে রাস্তাঘাটে মঙ্গোলয়েড চেহারার মানুষজন দেখেলেই 'চিঙ্কি' বা 'করোনা' বলার অভ্যাস কাটাতে হবে। তাহলে এটা জোর গলায় বলতে হবে, ডেরেক শভ্যাঁ কিছুতেই জর্জ ফ্লয়েডকে দিনে দুপুরে খুন করতে পারে না, বা কোনো 'ঠাকুর' কোনো 'দলিত'কে মন্দিরে ঢোকার অপরাধে মেরে ফেলতে পারে না। কাশ্মীর সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্তের সপক্ষে থেকে মনে মনে উল্লসিত থাকা অনুচিত হবে।

এই এত অবধি পড়ে, আপনার যদি মনে হয়ে থাকে আমি বড়ই গোলমেলে সব সূত্রের অবতারণা করছি , তাহলে বলব, এ সবই গত কয়েক বছরের বিবিধ কেন্দ্রীয় সরকারী শিক্ষার সুফল। গোমূত্র খেয়ে যদি করোনা সারে, তাহলে আমি রথযাত্রার গল্পে কাশ্মীর টেনে আনতেই পারি। চীন কিংবা পাকিস্থানের অন্যায় রাজনৈতিক এবং সামরিক সিদ্ধান্তের সপক্ষে আমি নই। কিন্তু নিজে যেহেতু যুদ্ধ করতে যাবনা, তাই কথায় কথায় ঘরে বসে যুদ্ধের আস্ফালন করাটাও অপ্রয়োজনীয় মনে করি। লাদাখের বা কাশ্মীরের সীমান্তে যুদ্ধ শুরু হলে হোক, আমি তো কলকাতায় খুব নিরাপদে থাকব, এমন ভাবনা ভাবি না। প্রাণনাশকারী যুদ্ধ -সে খন্ডযুদ্ধই হোক বা মহাযুদ্ধ, সৈনিকদের প্রাণ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ওপর নির্ভরশীল আরও বহু মানুষের জীবন টালমাটাল করে দেয়। ঘুরে ফিরে আসে পাপী পেট কা সওয়াল। আর যুদ্ধই হোক বা অতিমারী - গায়ের চামড়া, চোখের আকৃতি বা দৈহিক উচ্চতার পরোয়া করে না, সেটা বোধ হয় আর না বললেও চলে।

আমার এই দুর্ভাগা দেশের আপাতত দুর্ভাগ্য একটাই - আমাদের রথ,পথ,মূর্তি , সবগুলোই ছাপ্পান্ন ইঞ্চির থেকে আসলে বেশি, এমন ভাবতেও আমরা ভুলে যাচ্ছি, বা বলা ভালো, ভুলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। এখন সত্যিই সদাহাস্যমুখ অন্তর্যামী একমাত্র ভরসা।