বাড়ি থেকে শেষ বেরিয়েছি ২১শে মার্চ সন্ধ্যেবেলা। সেদিন আমাদের পাড়ার বাজারে , রাস্তায়,কোনো মানুষের মুখে মাস্ক ছিল না। আমারও ছিল না। ঘন্টাখানেকের জন্য অদ্ভূত আতংকের মধ্যে থেকে বাড়ি ফিরেছিলাম দরকারি কিছু জিনিষ কিনে। ঋতুপরিবর্তনের ফলে স্বাভাবিক গলা খুশখুশ করল। আমি বোধহয় সংক্রমিত হয়েছি --- এমন আতংকে খানিক্ষণ বুক ধড়ফড় করল। ধীরে ধীরে নিজেকে শান্ত করলাম। আমার কিছু হয়নি।

সেই একবিন্দু আপেক্ষিক শান্তি নিয়েই ঘরবন্দী হয়ে রয়েছি গত ...কতদিন? হিসাব থাকছে না। বাইরের যেটুকু বাজার করার দরকার, করে আনছে আমার ভাই। আমাকে বেরোতে দিচ্ছে না বা আমায় বেরোতে হচ্ছে না - ব্যাপারটাকে দুইভাবেই দেখা যায়। আরও বেশ কিছু আপাত  'প্রিভিলেজ' এর সঙ্গে এটাও আমার ব্যক্তিগত 'প্রিভিলেজ'।

'প্রিভিলেজ'- করোনা আক্রান্ত সময়ের শব্দপঞ্জী যদি কোনোদিন আলাদা করে নির্মিত হয়, তাহলে এই শব্দটির জায়গা হবে একেবারেই প্রথমে। অভিধান খুলে দেখলাম, 'প্রিভিলেজ'-এর বাংলা হল 'পদমর্যাদা, শ্রেণী বা ব্যক্তিগত অধিকারবলে প্রাপ্ত বিশেষ সুবিধা/ সুযোগ/ সৌভাগ্য'/ 'বিশেষাধিকার'। এই অতিমারী আমাকে বোঝাল, ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে, ডিজিটাল ইন্ডিয়াতে নিজের মাথার ওপরে ছাদ, পেটের খাবার আর সঞ্চয়ে মোটা টাকা থাকাটাই 'প্রিভিলেজ'।  আধুনিক যুগের একটা স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের সমস্ত নাগরিকের যা যা প্রাপ্য এবং অধিকার বলে জেনে এসেছি, পাঠ্যবইতে পড়ে এসেছি, পরীক্ষায় লিখে নম্বর পেয়ে এসেছি,  সেই সমস্ত প্রাপ্তব্য সুযোগ এবং সুবিধাগুলির মধ্যে সবকটি বা কয়েকটি যদি আমি কপাল্গুণে পেয়ে থাকি, তাহলে আমি আদতে 'প্রিভিলেজ্‌ড/ বিশেষ সুবিধাভোগী'। করোনাভাইরাস আমার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, কী মূর্খের স্বর্গে বসবাস করছি। আমাদের সুখী,সাজানো,শহুরে, ফেসবুক- ইনস্টা-টুইটার-টিকটক অধ্যুষিত দিনযাপনের গপ্পে ভরা, স্মার্টফোন- অ্যাপ-ক্যাশলেশ পেমেন্ট-অনলাইন শপিং -সমৃদ্ধ, একেবারে 'শাইনিং'  ফিনফিনে কাঁচের প্রাসাদটি , আর যাই হোক, মোটেও বুলেটপ্রুফ কাঁচের তৈরি নয়। আর বুলেটপ্রুফ কাঁচ ও নাকি এক জায়গায় বার সাতেক আঘাত করলে ফেটে যেতে বাধ্য।  উন্নতির ফাঁকা বুলিতে নেশাগ্রস্ত আমরা কি ঠিক সেই ভাঙনের অপেক্ষাতেই রয়েছি?

দ্বিতীয় শব্দটি হল 'মাইগ্রান্ট' বা 'পরিযায়ী'। রুজিরুটির উদ্দেশ্যে দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে খেটে খেতে যাওয়া মানুষজন, যাঁদের মধ্যে বেশিরভাগের প্রথাগত শিক্ষা বা উচ্চশিক্ষা নেই, এবং পারিবারিক সঞ্চয়ের ভিত্তির নিশ্চিন্ততা নেই, তাঁরা সবাই কী কারণে চিহ্নিত হয়েছেন 'মাইগ্রান্ট' হিসাবে, আমার জানা নেই। মাইগ্রেশন বা পরিযানে তো শীত গ্রীষ্মের নিয়ম মেনে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যায় পাখিরা, জেব্রারা, প্রজাপতিরা। যে মানুষগুলি বছরভর অন্য শহরে থেকে , সেই শহরের এবং দেশের অর্থনীতি সচল রেখে, বছরে এক বা দেড় মাসের জন্য নিজের পরিবারের কাছে দেখা করতে ফিরে যায়, তাদের কি এইভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব? তাহলে চকচকে আইটি সেক্টর বা এফ এম সি জি সেক্টরে বা বিনোদন ব্যবসায় কাজ করার জন্য অন্য শহরে বা অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করেন যাঁরা, তাঁদের কেন 'মাইগ্রান্ট ' বলে চিহ্নিত করা হয় না? তাঁদের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি আছে,  শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অফিস আছে, বহুতল আবাসনে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করে বা কিনে থাকার ক্ষমতা আছে, মোটা ব্যাংক ব্যালান্স আছে, তাই কি তাঁদের 'মাইগ্রান্ট' বা 'পরিযায়ী' বলতে বাধো বাধো লাগে? অর্থাৎ, আমি 'পরিযায়ী' তকমা পাব কি পাব না, আসলে নির্ভর করছে আমার উপার্জন, কাজের ধারা এবং সামাজিক অবস্থানের ওপর? ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলে, পশ্চিমবঙ্গের কোনো প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কেরালায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতে যাওয়া মানুষটার সঙ্গে, মুম্বই থেকে ইউরোপের কোনো দেশে বহুজাতিক সংস্থায় দামী চাকরি করতে যাওয়া মানুষটির উদ্দেশ্য কিন্তু একই - নিজে ভালো থাকা, নিজের পরিবারকে ভালো রাখা; আরও বড় করে ভাবতে ইচ্ছা করলে দেশের উন্নতি করা। তাই সহজ হিসাবে প্রথমজন যদি 'পরিযায়ী' হন, দ্বিতীয়জন ও সেই দলেই পড়েন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এই হিসেবটাও এমন সহজ নয়। তাই একদলের জন্য যখন দেশের তরফে বিমানের ব্যবস্থা হয়, অন্যদলের ভরসা তখন পায়ে হেঁটে ১৪০০-১৫০০ কিলোমিটার পথ পেরোনো। করোনা-প্রভাবিত শব্দপঞ্জীতে 'মাইগ্রান্ট লেবারার' বা 'পরিযায়ী শ্রমিক' - এই শব্দবন্ধটির জন্য পাতার পর পাতা টীকা লিখেও তার যাথার্থ্য প্রমাণিত হবে কি ?

নিজের বন্ধ ঘরের 'প্রিভিলেজ'-এর মধ্যে থেকে, 'মাইগ্রান্ট' তক্‌মা গায়ে না সেঁটে, ল্যাপটপে বসে বসে দু-চার কলম কিছু লেখার চেষ্টা নিশ্চিন্তে করতে পারছি যাঁদের জন্য, সেই 'ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র্‌স' বা প্রথম সারির যোদ্ধাদের সাহস, মানসিক স্থৈর্য্য, এবং সার্বিক প্রচেষ্টাকে আভূমি কুর্ণিশ জানানো ছাড়া আমার বিশেষ কিছু করার নেই। এই যুগ বিজ্ঞাপনের যুগ। সকালের মাজন থেকে রাতে জোলাপ অবধি সব কিছু--- হিসেবি ছবি, লেখা, হ্যাশট্যাগ সমেত সাজিয়ে জনমানসে পরিবেশন না করলে নিজের, মাজনের কিংবা জোলাপের জনপ্রিয়তা ধরে রাখা নিশ্চিত করা যায় না। তবুও, থালা বাজিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে বা ফুল ছড়িয়ে প্রামাণ্যরূপে ধাপে ধাপে তাঁদের উজ্জীবিত করার প্রচেষ্টায় আর শামিল হতে পারলাম কই? কিছুদিন আগে খবরে দেখেছিলাম, দক্ষিণ ভারতের এক দরিদ্র নারী নিজের থেকে শীতল পানীয় কিনে গরমে রাস্তায় টহল দেওয়া পুলিশকর্মীদের জন্য নিয়ে গেছিলেন। বা এই কলকাতাতেই এক  অবসরপ্রাপ্ত নার্স একইভাবে রোজ এলাকার পুলিশকর্মীদের জন্য বাড়ি থেকে লেবুর শরবত নিয়ে যান, নিয়ম করে তাঁদের রক্তচাপ মেপে দেন। এমন কিছু করতে যদি পারতাম...!

সত্যি কথাটা হল, আমি আসলে 'ফ্রন্টলাইন' কেন, 'লাস্টলাইন ওয়ারিয়র' ও নই। নিজেকে গৃহবন্দী করে রাখাটা যদি যুদ্ধের অঙ্গ হয়, তাহলে হয়ত আমি কাগজে-কলমে নির্দিষ্ট তালিকাভুক্ত 'যোদ্ধা', নইলে নই। নিজেকে এই দুনিয়ার জন্য প্রবল প্রয়োজনীয় কোনোদিন মনে না করলেও, এমন অপ্রয়োজনীয় এবং অক্ষম কোনোদিন মনে হয় নি। প্রতিদিন দুইবেলা গরম ভাতের গ্রাস মুখে তুলতে তুলতে নির্লিপ্তি নিয়ে টিভির পর্দায় দেখে চলেছি অভুক্ত মানুষের অভিনিষ্ক্রমণ। 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' ছায়াছবিতে গুপী-বাঘা গান গেয়ে হাল্লা রাজার অভুক্ত সেনাবাহিনীর জন্য আকাশ থেকে মন্ডা-মিঠাই নামিয়ে এনেছিল। আমার পেশাগত বা শখের কাজকর্ম- দুইয়ের কোনোটারই এমন জাদুকরী শক্তি নেই। নিজের পাহাড়প্রমাণ অক্ষমতার ধুলোমুঠি প্রায়শ্চিত্ত করতে দুই একটি উদ্যোগে সামান্য কিছু টাকা পাঠানো ছাড়া আর বিশেষ কিছু করতে পারিনি। 'খুব খিদে পেয়েছে' --- এমন কথা মনে হলেই চোখের সামনে ক্ষণিকের তরে ভেসে আসছে অভুক্ত, ক্লান্ত শিশু-নারী-পুরুষের কান্নাভেজা কিন্তু আত্মসম্মানে দৃঢ় মুখ। না, এর ফলে নিজের খাওয়া বন্ধ করে বসে থাকছি, এমন মহৎ মানুষ আমি নই। কিন্তু এই অক্ষমতার অবসাদ হয়ত আগামি বহুদিন আমার আশেপাশে ভেসে বেড়াবে, হেমন্তসন্ধ্যার মলিন কুয়াশার মত।

আর তাই যাঁরা করছেন - কমিউন করে মানুষকে খাওয়ানোর কাজ, প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষের কাছে খাবার পৌঁছানোর কাজ, ফুটপাথের শিশুদের এবং তাদের পরিবারের খাওয়াদাওয়ার ভার নিয়েছেন যাঁরা, ছবি এঁকে, হস্তশিল্প বিক্রির মাধ্যমে দুখী মানুষের অন্নসংস্থান করছেন যাঁরা, সেই সমস্ত আলোর উৎসের দিকে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে থাকি আমি। এই অতিমারী আমাকে আমার দেশ চেনাচ্ছে নতুনভাবে, প্রতিদিন। এই অতিমারী আমাকে এটাও বোঝাচ্ছে, সাধারণ মানুষই পারেন একে অপরের সহায় হতে; মানুষে মানুষে যে সহমর্মিতা, তার মাঝে কোথাও গিয়ে পুরোপুরি নিরর্থক হয়ে পড়ে জাতি-ধর্মের ঠুনকো ভেদাভেদ।এই অতিমারী আমাকে বোঝাল, প্রচুর 'প্রিভিলেজ'-ও অনেক সময়ে কাজে লাগে না। এই অতিমারী আমাকে আবার শেখাল জীবনে ভোগ্যপণ্যের প্রয়োজনীয়তা আর চাহিদার তফাৎ। এই অতিমারী আমাকে জানাল, আমার ভারত আসলে ততটা ডিজিটাল, ততটা শাইনিং নয়, যতটা আমাকে ভাবতে শেখানো এবং বাধ্য করা হয়। এই অতিমারী বারে বারে দেখাল, হাতে গোনা ডজনখানেক ধোঁয়াশাঢাকা বহুতল অধ্যুষিত মহানগর আসলে ভারতবর্ষ নয়; বরং পোড়া, শক্ত রুটির ভরসায় হাঁটতে থাকা, একটি পুঁটুলির মধ্যে নিজের জীবনকে গুছিয়ে বেঁধে চলতে থাকা, চলতে চলতে নিজের দুঃখ নিয়ে গান বাঁধার মানসিক জোর থাকা, 'পরিযায়ী' ছাপ্পামারা, গায়ের-জোরে-খেটে-খাওয়া, রোদে-পোড়া-জলে-ভেজা-শীতে-কাঁপা ভারতবর্ষের তামাটে, রুক্ষ শরীরে কয়েকটা শখের রঙিন উল্কি মাত্র।

২০১৭ সালে 'সই' আয়োজিত 'সইমেলা'-র  বিষয়বস্তু ছিল 'ভূমিকন্যা' । ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জড়ো হয়েছিলেন বিভিন্ন স্থানীয় ভাষার লেখিকা এবং শিল্পীরা। আহমেদাবাদের 'বুধন থিয়েটার'-এর তরফ থেকে এসেছিলেন তেজস্বিনী নাট্যকর্মী কল্পনা গাগডেকর। সেদিন কল্পনার আধাঘন্টার একক অভিনয় এবং পরে তাঁর সঙ্গে একান্তে কথাবার্তা হওয়ার সুযোগ পেয়ে  জেনেছিলাম, আমাদের এই দেশে আজও কল্পনার নিজের জনগোষ্ঠীর ( 'ছাড়া' জনগোষ্ঠী) মত আরও অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা 'ডি-নোটিফায়েড' বা 'বিমুক্ত' জনজাতি হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য, আজও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে কারণে বা অকারণে বিরূপ ব্যবহার পেয়ে থাকেন। কল্পনার দল তাঁদের পথনাটকের মাধ্যমে এই সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। 'সইমেলা'-র মঞ্চে অভিনীত সেই নাটকে কল্পনা এক অদ্ভূত রূপকের উত্থাপন করেছিলেন, যেটা আমার মাঝে মাঝেই মনে পড়ে, এবং এই আজকের দিনে, সেই রূপকটিকে আমি আরও ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারছি। কল্পনা তুলে এনেছিলেন 'স্বচ্ছ ভারত' প্রকল্পের 'লোগো'-টির কথা। এই লোগোতে, গান্ধীজির ব্যবহার করা চশমার আদলে আঁকা একটি চশমার দুটো লেন্সের জন্য নির্দিষ্ট দুটো বৃত্তাকার  ফ্রেমের একটাতে লেখা থাকে -'স্বচ্ছ', আর একটাতে লেখা থাকে -' ভারত'। 'স্বচ্ছ' আর 'ভারত' সর্বদা সমান্তরালে থাকে, মেলে না, একে অপরের মুখোমুখিও হয় না।

বিশ্বজোড়া অতিমারীর আবহে, সদা সংক্রমণের ভয়ে শঙ্কিত আমি 'স্বচ্ছ' লেবেলযুক্ত বৃত্তের পরিসরের ভেতর ,'প্রিভিলেজ'-এর মধ্যে থেকে, ঝুঁকে দেখছি, চিনছি, বোঝার চেষ্টা করছি... পাশের বৃত্তের 'ভারত'কে।

Published in Soi-Sabud: http://www.soicreativewomen.org/soi-sabud-may-2020-issue/157-privilege-er-modhye-theke-mahasweta-ray.html