শিক্ষক দিবসের সারাদিন ফেসবুকজুড়ে পোস্টগুলো প্রতিবছর পড়তে পড়তে বড়ই হীনমন্যতায় ভুগি। সব্বাই নিজেদের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সম্পর্কে কত ভালো ভালো কথা লেখে। পড়ে মনে হয় এদের জীবনে কী সুখ...।এদের স্কুলে একজনও পচা দিদিমণি বা স্যার ছিলেন না। কেউ একটা খারাপ কথা লেখে না। সব্বাই লেখে তারা কতজন, কতরকমের শিক্ষকের কাছ থেকে কত কী পেয়েছে। অথচ আমি এক পাজি, আমার স্কুল -কলেজ বললেই আগেই সেই মুখ গুলো মনে পড়ে,যাদের নিয়ে কিছু না কিছু একটা গপ্পো আছে, এবং সেই গপ্পোগুলি কোনোটাই খুব উৎসাহব্যঞ্জক নয়। আমাকে জীবনকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে একেবারে খোলনলচে পাল্টে দিয়েছেন, এমন শিক্ষকের নাম বা মুখও সহজে মনে পড়ে না, সেটাও আমারই কৃতঘ্নতা নির্ঘাত। এই আগের বাক্যদুটো লিখে মনে হল, এইবার আমার দিকে লোকজন বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইবে। বলবে, এ তো দেখছি ভারি ইয়ে মানুষ একখানা। শিক্ষক দিবসের মত পুন্যদিনে এহেন নোবেল প্রফেশন নিয়ে ওপেন ফোরামে এইসব কথাবার্তা লেখে... কিন্তু কী করব বলুন, বাড়িতে বাবা-মা থেকে স্কুলে প্রতি ক্লাসে কেউ না কেউ তো শিখিয়েছেন - সদা সত্য কথা বলিবে। মিথ্যা বলা মহা পাপ। তা আমি সদা সত্য না বলিলেও, মাঝেমধ্যে সত্য তো বলিতেই পারি, তাই না?

হিসেব বলছে বাড়িতে দশজনেরও বেশি আত্মীয় শিক্ষকতা পেশার সাথে যুক্ত ছিলেন বা আছেন। দেখা যাবে প্রতি দুজনের মধ্যে একজন বন্ধুও শিক্ষকতার সাথে যুক্ত। দেখতে গেলে জীবনে একবার করে শিক্ষক সবাই হয়েছে - হাইস্কুলে বা কলেজে পড়ার সময়ে বা যেকোনো চাকরি পাওয়ার আগে টিউশন করেনি এমন বাঙালি অন্তত সংখ্যায় কমই আছেন। তাই শিক্ষক দিবস, শিক্ষকতা, শিক্ষক ইত্যাদি নিয়ে লিখতে গেলে খুব বুঝে শুনে লিখতে হবে। বাবা-মা দুজনেই শিক্ষকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। চেয়েওছিলেন মেয়ে স্কুলে কিংবা কলেজে পড়াক। সবথেকে নিরাপদ কাজ। আলোয় আলোয় যাবে, শাঁখ বাজার আগে ভালোয় ভালোয় ঘরে ফিরবে। অন্যান্য অনেক আশার মতই বাবার-মায়ের এই আশাটাও আমি পূর্ণ করিনি। মফস্বলের স্কুলের মাস্টারমশাই-দিদিমণিদের মেয়ে হওয়ার কী চাপ, সেটা যারা হয় ( বা হত) তারা জানে। ছেলেরা অতটা চাপে থাকে বলে মনে হয় না, অন্তত আমার ভাই তো ছিল না। সর্বক্ষণ চারদিকে লোকজন তোমায় মাপছে। বাঁশের ওপর ব্যালান্সের খেলা দেখিয়ে প্রতিটা পা ফেলতে হয়। এক পা এদিক কি ওদিক, ব্যস, তোমার খিচুড়ি অন্য লোকে দায়িত্ব নিয়ে রেঁধে দেবে। আমার আবার একজন না, একসাথে ডাবল ধামাকা। ইনি মেয়েদের স্কুল, উনি ছেলেদের স্কুল; ইনি সকাল, উনি দুপুর; ইনি রঙিন পাড় সাদা শাড়ি, উনি ধুতি পাঞ্জাবী; ইনি ভোর চারটেয় উঠে আর রাত বারোটার পরে লাল চোখে পরীক্ষার খাতা দেখছেন, উনি বিশাল পরিবারের দায়-দায়িত্ব পালনের জন্য সকাল বিকেল বাড়তি আয়ের তাগিদে টিউশন পড়াচ্ছেন; রাস্তায় বেরোলে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে তিনজন হয় এনার ছাত্রী, নয় ওনার ছাত্র, নয় দুজনের কাছেই পড়েছেন অনেক কাল আগে যখন ছেলেদের আর মেয়েদের স্কুল আলাদা হয় নি। এমতাবস্থায়, কোন পাগলের সাধ জাগে, আবার স্কুলের টিচার হতে? তাই আমারও হয়নি। তার মধ্যে আমার চেহারাখানাও গোলমেলে। বহু লোকে বলেছে, আমাকে দেখলেই নাকি মনে হয় আমি স্কুলের প্রচন্ড খিটখিটে, কড়া, বড়দিমণিদের মত দেখতে, মানে চাইলেই এক্ষুনি 'নীল ডাউন' করিয়ে দেব। তাই শুনে মনে হয়েছে, আমি দিদিমণি না হয়ে ভালোই করেছি। চেহারা এবং কাজকর্ম এরকম মসৃণভাবে মিশে গেলে জীবনটা তো পুরো পাহাড়ি সান্যাল মশাইয়ের মত হয়ে যাবে ! ভদ্রলোক জীবনে কোনোদিন ভিলেন হতেই পারলেন না। সারাজীবন নায়িকাদের আদর্শ বাবা, মামা, কাকা, দাদা ইত্যাদি হয়ে কাটিয়ে দিলেন- আমি ওর মধ্যে নেই বাপু। কিন্তু শেষ রক্ষে হয়নি। এখন আমার ভাই, যে কীনা একগাদা উজ্জ্বল ছেলেমেয়ের 'স্যার', সে আমারও স্যার হয়ে আমার চারদিকে গম্ভীর মুখে মোটা মোটা বই নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আমার আর 'শিক্ষকযোগ' কাটল না।

যাইহোক, যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এটা কি আশ্চর্যের বিষয় না, যে আমাদের সময়ে ( মানে আমরা যারা এখন বাবা-মায়ের পর্যায়ে পড়ি) সবারই স্কুল-কলেজ বেজায় ভালো ভালো সব আদর্শ শিক্ষকে পরিপূর্ণ ছিল। তাহলে নিয়মমাফিক তাঁদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের প্রজন্মেরও সব শিক্ষকেরই অতি ভালো হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কই? আজকাল তো সবার মুখেই এক কথা শুনি - স্কুলে কিছু পড়ায় না। তাই বাড়িতে আজকাল এক প্রস্থ গৃহশিক্ষকে কুলায় না, দুই প্রস্থের ব্যবস্থা করতে হয়। তারপরেও মনে যথেষ্ট শান্তি আসে না। কেন, সে বিষয়ে আলোচনা করা আমার কম্ম নয়। বরং আমার স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ফাঁকিবাজ এবং ধড়িবাজ শিক্ষকদের গপ্পো করি।কোনো কোনো শিক্ষকেরা ফাঁকিবাজ হবেন না, এমন কথা কোনোও মোটা নিয়মের বইতে লেখা নেই। তিনি মানুষ হিসাবে যদি মনে করেন, তাঁর জন্য নির্ধারিত যেকোনো কাজেই তিনি ফাঁকি মারবেন, তাহলে ক্লাস নিতে গিয়েও ফাঁকি মারবেন। পাকেচক্রে 'শিক্ষক' হয়েছেন বলে অকারণ মহৎ আদর্শের ট্যাগ তাঁকে গলায় ঝোলাতেই হবে, মেগাসিরিয়ালমার্কা এমন মাথার দিব্যি - আজকাল কেন, কোনোদিনই কেউ কাউকে দিয়েছিল বলে আমার মনে হয় না।

আমাদের একজন দিদিমণি ছিলেন, তিনি নিজের বিষয় পড়াতে এসেই কী করে যেন পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার গল্পে চলে যেতেন। আরেকজন দিদিমণি, একই রকম ভাবে, নিজের বিদেশ ভ্রমণের গল্পে চলে যেতেন। একজন এত বেশি বকতেন, এত রাগী ছিলেন, যে তিনি আদৌ ভালো করে পড়ালেও আমরা পড়ায় মন দেওয়ার বদলে ভয়ে কাঁপার দিকে বেশি মন দিতাম। স্কুলেরই বাৎসরিক অনুষ্ঠানে যোগদান করার জন্য ক্লাস কামাই করলে আরেকজন বেজায় বকতেন। এ বিষয়ে বকুনি খেতে হবে কেন আজও বুঝিনি। বকবেনই যদি, তবে খামোখা অনুষ্ঠান করার দরকার কি? একজন শিক্ষক বাজারচলতি মানে বই খবরের কাগজ মলাট দিয়ে এনে সেটার থেকে প্রশ্নোত্তর লিখিয়ে যেতেন। একদিনও এক বিন্দু পড়ান নি নিজের বিষয়। আরেকজন সেটুকু পরিশ্রমও করতেন না। দু'বছরে নিজের বিষয়ের কিছুই বুঝিয়ে উঠতে পারেন নি আমাদের। আরেকজন ক্লাসে এসে নিজের বিষয়ের শুধু সেইটুকুই বলে উঠতে পেরেছিলেন, যেসব বিষয় আমরা ক্লাস ফোর ফাইভ থেকে পড়ে পড়ে মুখস্থ করে ফেলেছি।একই অভিজ্ঞতা হয়েছে কলেজে উঠে। এক অধ্যাপিকা যখন ক্লাস ফাইভ থেকে পড়ে আসা বিষয়ে নতুন কোনো আলোকপাত কিছুতেই করতে পারলেন না, তখন বাধ্য হয়েছি ক্লাস কেটে ক্যান্টিনে গিয়ে বসে থাকতে। তৎকালীন বেথুনের মত কঠিন অনুশাসনে বাঁধা কলেজে সেটা খুব সহজ কাজ ছিল না। স্কুলে থাকাকালীন, আমারই এক বন্ধু, যে অন্য স্কুলে পড়ত, সে প্রয়োজন ছাড়াই বাধ্য হয়েছিল একটা বিষয়ে টিউশন পড়তে যেতে, কারণ সেই শিক্ষক তাকে বলেছিলেন , তাঁর কাছে পড়তে না গেলে প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেবেন।

এসব অভিজ্ঞতা কি শুধুই আমার? আর কোনোও স্কুলে বা কলেজে কারোর হয়নি? এছাড়াও একজন ছাত্রীকে , শুধুই মেয়ে বলে, পুরুষ শিক্ষকেদের কাছ থেকে কতরকমের ব্যবহার পেতে হতে পারে, সে বিষয়ে তো নাই বা লিখলাম।

প্রচুর প্রিয় মানুষ শিক্ষকতার সাথে যুক্ত ছিলেন এবং আছেন। প্রচুর প্রিয় শিক্ষক , বয়সে বড় আত্মীয়-বন্ধু, সময়বয়সী বন্ধুরা, সম্পূর্ণ অচেনা মানুষেরা, এমনকী বয়সে ছোটরাও অনেকেই, একটু একটু করে আজকের আমাকে আমি হতে সাহায্য করেছেন - সে আমি বেজায় পাজি বা কৃতঘ্ন, যেমনই হই না কেন। তাঁদের প্রত্যেকের প্রতি আমার অফুরন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আছে। কিন্তু এই মধ্যবয়সে এসে বুঝি, 'শিক্ষকতা' - আজও, এই পেশার সাথে অকারণেই প্রচুর আবেগ জড়িয়ে যায়- তবে সেটা বছরের এই একটা দিনে । আবেগ, শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা- কোনো কিছুই অতিরিক্ত হওয়াটা ভালো না। দুনিয়াটাতো দেওয়া নেওয়ার নিরিখেই চলে শেষ অবধি। আমাদের গল্পে-উপন্যাসে পড়া বা বাস্তবেও দেখা বিনে পয়সায় পড়িয়ে দেওয়া শিক্ষকেদের দিন যেমন চলে গেছে, তেমনি চলে গেছে মোটা টিউশন ফী দেওয়া বাবা-মায়েদের তরফে শিক্ষকতা পেশাটাকে আলাদা করে দেখার মত ইচ্ছেগুলোও। চারিদিকে স্কুলে-কলেজে চাকরি পাওয়া এবং ভর্তি হওয়ার বিবিধ পদ্ধতি থেকে শুরু করে ছাত্রদের প্রতি শিক্ষকদের ব্যবহার এবং শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের ব্যবহারের অভাবনীয় সব গল্প শুনি। তারপরে শিক্ষকতা নিয়ে, শিক্ষক দিবস নিয়ে এই একদিনের লাল-নীল-হলুদ-সবুজ সুখী সুখী ডিজিটাল আদিখ্যেতা মেনে নিতে বেজায় অসুবিধা হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের তরফে হইচইটা তাও বুঝি, একদিন সকাল বেলা কর্মক্ষেত্রে গিয়ে হাসিমুখে ফুলের তোড়া বা উপহার পাওয়ার আনন্দে আনন্দিত শিক্ষকদের ছবি-অভিজ্ঞতা শেয়ার করে নেওয়ার ইচ্ছেটাও বুঝি; কিন্তু তাই বলে সকাল থেকে বাকি সব্বার এই বছরের পর বছর শিক্ষক-দিবস- স্ট্যাটাস দেওয়ার হুজুগটা সত্যিই বুঝি না।

আমার বুঝতে অসুবিধা হলে অবশ্য কারোর কিছু যাওয়া আসার নয়।

Facebook Link: https://www.facebook.com/mahasweta.ray/posts/10155932232577494

তবে এই লেখা পড়ে কেউ কেউ বা সবাই রেগে গেলেও আমার কিছু করার নেই। সব সত্যি লিখলাম, বা বললাম। কারণ জীবনের প্রথম শিক্ষকদ্বয়- মা আর বাবা, আর তারপরের যাবতীয় পছন্দের শিক্ষকেরা সেরকমই করতে চিরকাল ধরে বলে আসছেন।