মহালয়ার ভোরবেলা অ্যালার্ম বাজিয়ে চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে, ধূপ জ্বালিয়ে, ল্যাপটপ খুলে মহিষাসুরমর্দিনীর সিডি চালিয়ে দিলাম। প্রত্যেক বছরের মতই ভাবলাম, এইবার পুরো অনুষ্ঠান শুরু থেকে শেষ অবধি শুনবো। আমার সিডি টা ভিডিও সিডি। তাতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় যখন উদাত্ত স্বরে শোনা যায় "যা দেবি সর্ব্বভূতেষূ --- " তখন স্ক্রিনের ওপর পাটের চুল দাড়ি লাগানো বরষীয়ান অভিনেতা মনু মুখার্জীকে দেখা যায় চট দিয়ে তৈরি স্টুডিওর কুঁড়ে ঘরে বসে সেই বজ্রগম্ভীর কন্ঠের লিপ দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে নীল আকাশ, কাশ ফুল, দুর্গার মুখ, নৃত্যরতা মহিলা, লালপেড়ে শাড়ী পরা বাঙালিনী --- আমার ভালো লাগে না। কিরকম যেন মনে হয় একটা অপার্থিব ঘটনাকে জোর করে টেনে নামিয়ে আনা হচ্ছে। 'মহিসাষুরমর্দিনী' দেখার নয়, শোনার, অনুভব করার ---অন্ধকার ঘরে বালিশ আঁকড়ে বিছানায় শুয়ে নিজের অজান্তেই রোমাঞ্চিত হওয়ার --- এক বিশেষ অভিজ্ঞতা।


তাই আমি কোন দিনই সিডির ছবি অংশটুকু দেখিনা। ইদানীং রেডিওতেও শুনি না। কারণ সত্যি বলতে কি, আকাশবানীর সম্প্রচার এ কি হয় জানিনা,অনেকদিন শুনিনি, কিন্তু এফ এম চ্যানেল গুলি যা করে, সেট ক্ষমার অযোগ্য। আমি বার তিনেক শোনার চেষ্টা করেছি বিভিন্ন চ্যানেলে, সবাই এক! এক মন্দ্রগম্ভীর অনুষ্ঠান চলার মাঝখানে তারা বাধ্য করে তাদের নিজস্ব জিঙ্গল শুনতে, মাঝে মাঝে অন্যান্য বিজ্ঞাপনও থাকে। সে যে কি অসহ্য!! পন্যসংস্কৃতির যুগে ৩৬৫ x ২৪ ঘন্টার মধ্যে মাত্র দেড় ঘন্টাও তারা আমাদের ছাড় দিতে রাজি নয় ! তাই আমিও তাদের এই দেড় ঘন্টার জন্য ত্যাগ করেছি। ভাগ্যিস অনুষ্ঠানটির সিডি পাওয়া যায়। অন্তত নিজের মত করে, চোখ বুজে ডুবে যাওয়া যায় সঙ্গীত-কাব্য-চন্ডীপাঠের এক অনন্য অভিজ্ঞতায়।



এবারো শেষ পর্যন্ত পণরক্ষা হল না। খানিক্ষণ আলো জ্বেলে বসে থেকেই মনে হলো এত আলোতে ঠিক ব্যাপারটা জমছে না। তাই আলো নিভিয়ে 'নম চন্ডী, নম চন্ডী ---" শুনতে শুনতে শুয়ে পড়লাম আবার। আর তখনই হটাত করে মনে পড়ে গেল একটা নাম আর একটা ছবি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ছায়াছবি নিয়ে অনেক রকমের থিওরি পড়তে হয়েছিল। তার মধ্যে একজন ছিলেন সিগফ্রিড ক্রাকোয়া (Siegfried Kracauer ). তাঁর "Theory of Film:Redemption of Physical Reality" বইয়ের শেষ পরিচ্ছেদে 'অপরাজিত' নিয়ে আলোচনা করে তিনি বলেছিলেন, 'অপরাজিত' এক সর্বকালীন ছবি। এই ছবিতে দূর শহরে পড়তে যাওয়া ছেলের ফিরে আসার জন্য মায়ের যে অপেক্ষা, আর অপরদিকে সদ্য বড় হওয়া ছেলের কাছে মায়ের টানের থেকে অনেক বেশি আকরষণীয় অজানা, অদেখা নতুনের টান - এই টানাপোড়েন বিশ্বের সব মা আর সন্তানের গল্প। পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তেই ঘরে থাকা মা অপেক্ষা করে থাকে ছুটির দিনে তার সন্তানের ঘরে ফেরার দিকে তাকিয়ে, আর সব সন্তানই ফিরে আসে, কিন্তু কিছু সময় পরে আবার ফিরেও যায় নিজের নতুন ঠিকানায়।



লেখকের নাম টা অবশ্যি তক্ষুনি মনে পড়েনি, বরং আধো-ঘুমে আধো জাগরনে বৃটীশ কবি সিগফ্রিড সাসুনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে , এতদিন পরেও আমার নামটা মনে আছে- কি আশ্চর্য!! ভেবে আত্মতুষ্টিতে ঘূমিয়ে পড়লাম। আমার স্পিকারে তখন মহিষাসুরের সঙ্গে মা দুর্গার ভয়ানক যুদ্ধ চলছে। সেই ঘনঘটাপূর্ণ সঙ্গীত এবং ভাষ্যকে পটভূমিকায় রেখে অপরাজিত, আমার বাড়ী ফেরা, অপরাজিত ছবির সেই শেষ দৃশ্য, পুজো এইসব নানাবিধ ভাবতে ভাবতে তলিয়ে গেলাম নিবিড় ঘুমে।



কেন মনে পড়লো এই নাম এবং এই ছবি? আসলে যখন এই বইটা পড়েছিলাম, তখন থেকেই, মাঝে মাঝেই আমার মনে পড়েছে এই বইটার কথা, আর 'অপরাজিত'র কথা। অপুর সঙ্গে আমার খুব মিল। শুধু আমার না, আমার ভাই, আমার পিসতুতো ভাই বোনেদের, আমার পাড়ার সাগর, সৈকত, টুপাই- সব্বার খুব মিল। কারণ আমরা সবাই একেকজন অপু। কর্মসূত্রে অথবা পড়াশোনার জন্য বাড়ী থেকে দূ্রে থাকি। বেশিরভাগ কলকাতা, কেউ গুজরাত, কেউ অন্ধ্রপ্রদেশ, কেউ মুম্বই, কেউ বা আরো দূরে, কেউ একটু কাছে। বছরে দুই বা তিনবার বাড়ী আসি। অন্য সময়ে না পারলেও পুজোয় তো আসি-ই। আমাদের বাড়ী পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খন্ডের সীমানায় এক ছোট্ট শিল্পাঞ্চলের কাছে। কলকাতা থেকে আসতে ঘন্টা পাঁচ-ছয় লাগে। কেউ বা আসে মহালয়ার পর পরই। কেউ ষষ্ঠীতে বা সপ্তমীতে, কেউ বা কলকাতার পুজো পরিক্রমা সেরে অষ্টমী বা নবমীতে। কেউ কেউ ফিরতে পারে না।



কলকাতার তুলনায় আমাদের এখানে পুজোরগুলির জাঁকজমক অনেক কম। একটি বা দুটি পুজোর উদ্যোক্তারা চেষ্টা করেন কলকাতার অনুসরনে থিম পুজো করার, বাকিগুলি নিখাদ বারোয়ারি পুজো। মন্ডপসজ্জা, আলো, বা প্রতিমা, সবকিছুই এক নির্দিষ্ট গুণমানের। কিন্তু জাঁকজমক যতই কম থাক, উতসাহ আর উদ্দীপনার কমতি থাকে না একফোঁটাও। ভোর চারটে না বাজতেই সবার ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য বাজতে থাকে 'মহিসাষুরমর্দিনী' । আর সারাদিন ধরে সানাই, আর মাঝে মাঝে স্বাদবদলের হিন্দি-বাংলা গান। ছোটরা এবং বড়রা বয়স অনুসারে মন্ডপের ভিতরে-বাইরে বসে আড্ডায় মেতে ওঠেন। সন্ধ্যা হতে হতে দল বেঁধে ভিড় জমায় কাছে-দূরের বিভিন্ন বসতির মানুষ।অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে বাড়ির গাছ থেকে ফুল পেড়ে নিয়ে যায় সবাই। নবমীর দুপুরে খিচুড়ী ভোগ। একাদশীর সন্ধ্যায় বিজয়া সম্মিলনীতে নানা রকমের নাচ-গান। আমার মত ঘর ফেরা অপুদের আলাদা পাওনা হল এক বছর পরে বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হওয়া।



তাই বছরের পর বছর ধরে, পুজোর ঢাকে কাঠি পড়লেই, ব্যাগ-বাক্সের ধুলো ঝেড়ে, তার মধ্যে জামা-কাপড় আর উপহারের টুকিটাকি ভরে, মহানগরের উৎসবের অমোঘ আকর্ষণ ত্যাগ করে বাড়ি চলে আসি। মনে করে ব্যাগে ভরি বাবার পছন্দের মিষ্টির বাক্স, মায়ের জন্য আসল জার্মান হোমিওপ্যাথি ওষুধ, আর গোপালের জন্য লাল-নীল জরিপাড় বসানো নতুন জামা। আসার পথে রেল লাইনের ধারে কয়েকগুছি কাশফুল দেখতে পেলে মন আনচান করে ওঠে। কোথাও বা স্টেশনের ধারে রঙ্গিন মন্ডপের সামনে বেলুন হাতে দাদুর কোলে ছোট্ট শিশু; ট্রেনের কামরার ভেতর ছূটির ডাকে উন্মনা লটবহর শুদ্ধ ভ্রমণপিপাসু বাঙালি। ফেরিওয়ালার হাতে নতুন পূজাবার্ষিকী।



শেষ বিকেলে ট্রেন থেকে যখন নামি, আশ্বিনের গোধুলিতে গাছপালায় ছাওয়া আমাদের ছোট স্টেশনটাকে তখন বড় মায়াময় লাগে। আমি ভারি স্যুটকেস টেন ওভারব্রীজ পেরোতে পেরোতে দেখি, ট্রেনটা কেমন বাঁক নিয়ে চলে যাচ্ছে আরো দূরে...আরো কত অপু পৌঁছে দিতে --- হয়ত তাদের নিশ্চিন্দিপুরে --- বা হয়তো কোন অজানার সন্ধানে --- আর অপুর সাথে, এই ছুটির কটা দিনে, চুপিচুপি সঙ্গ নিয়েছে -দুর্গা ।



----------------------------------------
এই পোস্টটি একই সংগে 'কফিহাউসেরআড্ডা'তেও প্রকাশিত হয়েছে।