প্রত্যেক বছর ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয়। সোমবার বা শুক্রবারে পড়লে কেউ কেউ উইক-এন্ডের সাথে জুড়ে নিয়ে ছোটখাট ট্রিপ মেরে আসেন। কেউ কেউ সকাল সকাল মাংস কিনে বাড়ি ফেরেন। কোন কোন স্কুলে পতাকা উত্তোলন হয়, প্যারেড হয়। কারোর কারোর ছুটি থাকে। আমাদের স্কুলের প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন খুব ভাল করে মনে আছে, কিন্তু স্বাধীনতা দিবসে কি হত ভুলে গেছি। স্কুলে যেতে হত বোধ হয়। কেন এত তাড়াতাড়ি এই তথ্য ভুলে গেলাম কে জানে।

আমার ছোটবেলায় ১৫ই আগস্ট মানে পুজোর বাজার শুরু। আমার বড় মামা ছুটিতে আসবেন আমাদের বাড়ি, তারপরে আমরা পুজোর বাজার করতে যাব। নতুন জামা কেনার, দর্জির কাছে মাপ দেওয়ার শুরু হল ১৫ই আগস্টের আশেপাশে।

স্বাধীনতা দিবস নিয়ে কথা উঠলে কিছু  মানুষ আছেন যাঁরা খুব বিরক্ত মুখে এই সমস্ত উতসবকে নস্যাত করেন। আমরা সত্যিই স্বাধীন কিনা, স্বাধীনতা পেয়েছি কিনা, যে স্বাধীনতা পেয়েছি সেটার ধরণ কি - এইসব নিয়ে গুরুগম্ভীর অথবা তীর্যক মন্তব্য করেন।

এই বিশ্বায়নের যুগে আমরা সত্যিই কোন দিক থেকে কতটা স্বাধীন সেটা হয়ত গভীর আলোচনার বিষয়। হয়ত খুব তাত্বিক ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আমি বা আমরা আদপে স্বাধীন নই। কোন না কোন ভাবে কোন না কোন সমাজব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার কাছে আমরা পরাধীন। ইচ্ছা না থাকলেও মেনে নিতে হচ্ছে এমন অনেক কিছু যা আসলে মানার ইচ্ছা নেই । তাই হয়ত রেগে মেগে বলতেই পারি - নিকুচি করেছে এমন স্বাধীনতায়! এ থাকা না থাকা সমান ! পালন করতে হবে না এহেন স্বাধীনতা।

কিন্তু  মানি না, মানব না বললেই কি আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? স্বাধীনতা দিবসকে অগ্রাহ্য করলে যে সাথে সাথে দেশের ইতিহাসকেও অগ্রাহ্য করা হয়, অশ্রদ্ধা জানানো হয় সেই শ'য়ে শ'য়ে নাম জানা এবং না জানা মানুষগুলিকে, যাঁরা দেখেছিলেন ইংরেজ শাসন থেকে নিষ্কৃত পাওয়া এক স্বাধীন মাতৃভূমীর স্বপ্ন। কি প্রয়োজন ছিল সেইসব তাজা প্রাণগুলির - নিজেদের সংসার, নিজের জীবন সম্পর্কে তোয়াক্কা না করে বিদেশী শাসকদের বোমা মারতে যাওয়ার, বা নানাবিধ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে একটা নতুন দিনের স্বপ্ন দেখার? কোন অধিকার আছে আমাদের, এই সব মানুষগুলির ভাবনা চিন্তাকে অসম্মান জানানোর?

ব্র্যান্ডেড জামাকাপড় পড়ে, কফিপাবে বসে মোকায় চুমুক দিতে দিতে দুর্বোধ্য শব্দ ব্যবহার করে স্বাধীনতা দিবসকে নিয়ে কাটা ছেঁড়া যাঁরা করতে চান, করুন। আমার ইতিহাসচেতনা আমাকে বলে, নিজেকে নিজের সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিক বৃত্তগুলির মধ্যে স্বাধীন ভাবি বা পরাধীন, আমার উচিত স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় সঙ্গীত শুনে সম্ভ্রমে উঠে দাঁড়ানো, আমার উচিত আমার পরবর্তী প্রজন্মকে আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া; আমার উচিত হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলির ভাবনা-চিন্তা-চেতনাকে সম্মান জানানো। নিজের ইতিহাসকে অস্বীকার করা মানে তো নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। নিজেই নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করি কি করে?

নিয়ম করে ত্রিবর্ণ পতাকার সামনে গান গাই বা না গাই, একথা স্বীকার করতে একবিন্দু দ্বিধা নেই যে, যখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে এই গান শুনি, সমবেত গলায় গলায় মেলাই, তখন সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে, চোখে জল ভরে আসে...সে কি শুধুই ছোটবেলা থেকে লালিত অভ্যাসের ফল?