আজ কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। দুপুরবেলা টিভিতে একটি সংবাদ চ্যানেলে এক সেলেব্রিটির বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর ব্যবস্থাপনা নিয়ে বাইট দিচ্ছিল। অভিনেত্রী লাল পেড়ে শাড়ি এবং প্রচুর সোনার গয়না পরে আলপনা দিচ্ছেন, এবং রাতে বাড়ির পুজোর ভোগের ফিরিস্তি দিচ্ছেন। দেখতে দেখতে ভাই বলল - আজকাল কি সবকিছু নিয়েই প্রবল হইচই হয়...এই দুর্গাপুজো গেল...আগে দুর্গাপুজোর পরে কিরকম মন খারাপ হয়ে থাকত কতদিন, আজকাল কি মন খারাপও করেনা কারোর...?

করেনা কি? করে হয়ত, হয়ত করে না। এমনিতেই তো দশমী ছাড়িয়ে দুই দিন বেশি ধরে ভাসান চলছিল। তাই মা দুগগা যেতে যেতেও থেকে যাচ্ছিলেন। টিভিতে সেই সব ভাসানের ছবি দেখলাম- কোথায় ছৌ নৃত্য করতে করতে শোভাযাত্রা যাচ্ছে, কোথাও বা ঢাকের তালে তালে নাচ, কোথাও আবার সুন্দরী নায়িকারা সিঁদূর খেলায় মাতলেন। দুঃখ- টুঃখ অনেক দূর। শোভাযাত্রার আড়ম্বরে চোখের জল উধাও। দুঃখের থেকে আনন্দের মাত্রাই যেন বেশি। বোধ হয় এই জীবন যুদ্ধে বিপর্যস্ত জেট যুগে কেউই আর বিশেষ আলাদা করে দুঃখিত হতে চায় না। তাই দুর্গাঠাকরুণ কৈলাশে পৌঁছানোর আগেই মাঝ পথ থেকে  লক্ষ্মীঠাকরুণকে ফের ডেকে আনার তোড়জোর পুরোদমে। আর সেই কারণেই টিভি স্ক্রিন জুড়ে ফলমূল- নারকেল নাড়ু-কলার পেটো-ধানের ছড়ার সাথে সাথে সুন্দরী সেলিব্রিটিরাও রয়েছেন। যত আনন্দ খালি দুর্গাঠাকরুণের ভাগে, তাই বা হয় কি করে...?

আমাদের মফস্বলী ছোটবেলায় দেখতাম, দুগগাঠাকুরের ফেলে যাওয়া বিরাট বড় মন্ডপ অপেক্ষা করে রয়েছে লক্ষ্মীপুজো হওয়ার জন্য, টিমটিম করে জ্বলছে মাটির প্রদীপ - কলকাতা শহরের বিরাট বিরাট পুজোমন্ডপগুলিতে সেইরকম লক্ষ্মীপুজো হয় কিনা জানিনা। মফস্বলে তো সবাই দুগগা ঠাকুর ভাসান দেয় দশমীর দিনেই। আর এমনিতেই কম আলো। রাস্তাঘাট প্রায় অন্ধকার। তার মধ্যে দুর্গাপুজোর কয়েকদিন জেনারেটরের দৌলতে আলো ঝলমল মন্ডপ। তাই সেই কদিনে মনে হত আলো যেন অনেক অনেক বেশি। মাথা খোলা লরিতে চেপে, ব্যান্ডপার্টির বাজনার তালে তালে চড়া হ্যালোজেনের আলোতে আলোকিত হয়ে মা যখন সপরিবারে ফিরে যেতেন, তখন চারিদিকের অন্ধকার প্রেক্ষাপটে মা দুর্গাকে মনে হত আরো সুন্দর, স্পষ্ট দেখতে পেতাম মায়ের সিঁদুর-সন্দেশ মাখা মুখে কান্নাভেজা হাসি, চোখের কোণে জল। মোড়ের বাঁকে লরি ঘুরলেই সত্যি সত্যি যেন সব আলো নিয়ে চলে যেতেন মা দুর্গা। গলার কাছটা শক্ত শক্ত ঠেকত, বুকের মধ্যে মহা শূণ্যতা। তাই মনে হয় কষ্টটা অনেক বেশি করে লাগত।

বহুবছর বাংলার পুজো না দেখা, বিশেষ করে এই সুপারস্টার-মেগাস্টার পুজোর দুনিয়া সম্পর্কে আন্দাজ না থাকা আমার প্রবাসী ভাইয়ের কাছে সেই স্মৃতির নিরিখে তাই টিভির নিউসচ্যানেলের বাইট তো একটু চোখে লাগবেই...