চন্দননগরের কৃষ্ণপট্টী শেঠ লেনে আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে ছিল সন্টুদাদা-মন্টুদাদাদের বাড়ি। সে বাড়িটা আমাদের একটেরে ,লম্বাটে, বাড়ির থেকে একেবারেই আলাদা দেখতে।দোতলা বাড়ি, সামনে পেছনে বাগান,বাগানে ঢোকার বড় গেট, বাগানের লোহার রেলিং এর বাইরে বাঁধানো লম্বা বসার রোয়াক। সেই রোয়াকে বিকেলবেলা সাদা ধুতি -পাঞ্জাবি পরে গিয়ে বসতেন আমার দাদু। সঙ্গে বসতেন ওই বাড়ির কর্তা - তাঁকেও আমরা দাদুই বলতাম। তখন নাম জানতাম না, আমার কাছে উনি সন্টু-মন্টু দাদাদের দাদু। আমার দাদুর মত পরিপাটি ধুতি পাঞ্জাবির বদলে ওঁর পোষাক ছিল সাদা শার্ট বা ফতুয়া, আর লুঙ্গির মত করে পরা ধুতি। মাঝেমধ্যে ,কিংবা হয়ত রোজই, এসে বসতেন পাশের বাড়ির টকাই পিসির বাবাও। আমি দাদুর ঘরের জানলার ওপর উঠে বসে দেখতাম, আর দৃষ্টি -আকর্ষণের জন্য দাদু-দাদু করে ডাক দিতাম মাঝে মাঝে। গরমের ছুটি আর পুজোর ছুটিতে যেতাম, তাই নিয়মিত খেলার সঙ্গী সেই অর্থে ছিল না। আমি তখন ক্লাস থ্রি বা ফোর বা ফাইভ। মণিপিসি সকালের দিকে পুতুল খেলত বটে, কিন্তু তার তো পড়াশোনা ছিল, সারাক্ষণ তো আর আমার সঙ্গে রান্নাবাটি খেললে চলবে না। তাই বিকেলটা হয় নীচে রাস্তার ধারের ছোট রোয়াকে বসে কিংবা ওই দাদুর ঘরে জানলাতে বসে কেটে যেত অনেকদিন।


ওই বাড়ির দিদার লাল পাড় শাড়ি, চওড়া সিঁদুর ইত্যাদি কিছু পরিচিত চিহ্ন ছাড়া আর কিছু মনে নেই। সন্টু-মন্টুদাদার মা কিংবা বাবাকে একেবারেই মনে নেই।আমি ওই বাড়ির ভেতরে ঢুকেছি গুণে গেঁথে বার দুয়েক- একবার কোনো এক পুজোর দিনে দিদুর সঙ্গে। আর একবার দাদুর শ্রাদ্ধের দিনে। সেদিন বেলা হয়ে যাচ্ছিল, কলকাতা থেকে ফুল নিয়ে যাওয়ার কথা বাবার খুড়তুতো ভাই বাবুলাকাকুর, কিন্তু ট্রেনের বোধ হয় কিছু অসুবিধা ছিল, কখন আসবে বোঝা যাচ্ছে না, কাজ শুরু হওয়ার সময় হয়ে গেছে, তাই বেলা বেড়ে যাচ্ছে দেখে, বড়দের কথায়, আমি আর মণিপিসি গেছিলাম ওদের বাগান থেকে কিছু ফুল আনতে ,দাদুর ছবি সামনে সাজানোর জন্য। ওদের বাগানে ঢুকে ডানহাতে ছিল একটা বড় কামিনী গাছ। সেই গাছের ফুল ছড়িয়ে থাকত ওদের বাগানে, ওই বসার রোয়াকে। আমরা সেদিন আর কী ফুল পেয়েছিলাম ওদের বাগান থেকে মনে নেই, কিন্তু কিছু কামিনী ফুল কুড়িয়ে এনেছিলাম, দাদুর ছবির সামনে আমরা খুব যত্ন করে সাজিয়েছিলাম - এমন একটা আবছা স্মৃতি রয়ে গেছে।
ওই বড় লোহার গেট ওয়ালা, লোহার রেলিং দেওয়া, রোয়াকওয়ালা, ঝরা কামিনী ছড়ানো বাগানওয়ালা দোতলা বাড়িটার সামনের দেওয়ালে, একতলা আর দোতলার মাঝামাঝি, সাদা পাথরের ফলকে কালো অক্ষরে লেখা ছিল - 'পূর্ণ- বসন্ত'। পাশাপাশি এই শব্দদুটো আমার খুব পছন্দের ছিল। আমি মনে মনে ভাবতাম, নিশ্চয় ওবাড়ির দাদু আর দিদুর একজনের নামের খানিকটাতে 'পূর্ণ' শব্দটা আছে আর অন্যজনের নামের অংশ হল 'বসন্ত' ।কে পূর্ণ আর কে বসন্ত সেটা অবশ্য শেষ অবধি স্থির করতে পারিনি। আমার অনুমান আদৌ সঠিক কি না, কাউকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ বা পরিস্থিতিও হয়নি।


এখন অবশ্য মনে হয়, প্রবল রোমান্টিক মন না হলে নিজেদের বাসস্থানের এমন নাম রাখা সম্ভব নয়। ওবাড়ির দাদু কি খুব রোমান্টিক মানুষ ছিলেন? নামটা কি উনিই দিয়েছিলেন? কে জানে।


খুব রোমান্টিক কিছু মনে করার ভাবনা এলে, আমার 'পূর্ণ-বসন্ত' -কে মনে পড়ে।