গত সপ্তাহের শেষে চন্দননগর গেলাম। ফেরার সময়ে যে লোকাল ট্রেনে ফিরলাম, যেগুলি ই এম ইউ নামে পরিচিত, তার সব ঝাঁ চকচকে নতুন বগি। বাইরে পুরনো হলুদ সবুজের বদলে অনুজ্জ্বল সাদা আর কচুরিপানা ফুলের রঙ। জানলায় চেনা শিকের বদলে ধাতব জাফরি। এপাশে ওপাশে ডিজিটাল স্ক্রীন টাঙানো। সেখান বিন্দু বিন্দু লাল দিয়ে লেখা ফুটে উঠছে- ' পরের স্টেশন শ্রীরামপুর...' ।মেট্রো রেলের পরিচিত ঘরানায় সুললিত কন্ঠে ঘোষিকা জানাচ্ছেন, ' এ হল বালি স্টেশন। পরবর্তী স্টেশন বেলুড়...'। মাঝে মাঝে কিছু পরে পরে নিয়মমাফিক সাবধানবানী- নিজের জিনিষ সামলে রাখুন, পড়ে থাকা জিনিষ ধরবেন না, দাহ্য পদার্থ নিয়ে যাতায়াত করবেন না ইত্যাদি। লোকাল ট্রেন তার উস্কোখুশকো, একটু ঢিমে তালা, একটু আটপৌরে চেহারা বদলে আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড়ানোর চেষ্টা করছে, বুঝতে পারলাম। এইসব সাবধানবার্তা আগে কামরার দেওয়ালে লেখা থাকত। আজকাল কেউ ফেসবুকের দেওয়াল ছাড়া আর কোনোও দেওয়াললিখন পড়ে না বোধহয়। তাই কানে ঢোকানোর আপ্রাণ চেষ্টায় যান্ত্রিক মিষ্টতায় কানের কাছে গুনগুনিয়ে চলেন ঘোষিকা। 
বেলুড় স্টেশন পেরোলেই, লিলুয়া আসার আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় রেলের নিজস্ব কর্মকান্ডের জালিকা বিস্তার। পূব -পশ্চিমে শুরু হয়ে যায় আরও আরও রেললাইনের কাটাকুটি। তাদের মধ্যে কয়েকটা লাইন মূল লাইনগুলির শাখা-প্রশাখার মত বিস্তৃত হতে হতে রেল-ইয়ার্ডের পাঁচিলগুলির পেছনে, দৃষ্টিপথের বাইরে চলে যায়। কিছু লাইন আবার মাঝপথে এসে হারিয়ে যায়। হঠাৎ থমকে যাওয়া জীবনের মত। এই জায়গাতে এসে, সমস্ত ট্রেনেরই গতি খুব কমে আসে। স্টেশনে ঢোকার, ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম পাওয়ার অপেক্ষায় গতি কমিয়ে ধীরে ধীরে এগোয়, কিংবা থেমে থাকে ক্লান্ত যাত্রী ভরা দূরপাল্লার এক্সপ্রেস বা সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় উন্মুখ ডেইলি-প্যাসেঞ্জার-ঠাসা লোকাল ট্রেন। বাড়ির বড়রা মজা করে বলতে শিখিয়েছিলেন, এটা হল লিলুয়াআর হাওড়ার মাঝের স্টেশন- হালুয়া। হালুয়া আমার কাছে চিরকালীন এক রহস্যময় অঞ্চল।  লম্বা পাঁচিলের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা দরজা বন্ধ একলা কোচ, পুরনো ইঞ্জিন, মালগাড়ির গার্ড-কোচ - এই শেষের দুটি আজকাল আর চোখে পড়ে না, তার মাঝে কোথাও একটা একলা গামছা আর একটা একলা পুরনো লুঙ্গি পুটুশঝোপের ওপর গা এলিয়ে রোদে শুকায়, রেলের লাইনের ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘরে ফেরে স্কুলেফেরত একটি-দুটি ছেলে-মেয়ে; লাইনের সমান্তরালে চলে যাওয়া জলের পাইপের ফাটা মুখের পাশে তেল-সাবান নিয়ে স্নানে নিমগ্ন থাকে ডিউটি ফেরত লাইন্‌স্‌ম্যান; লাল দোতলা ইয়ার্ড অফিসের খোলা জানালায় দায়িত্ব সামলায় বিষণ্ণ সবুজ পতাকা। সময়ে-অসময়ে  আরেকটা যাত্রীবোঝাই ট্রেন সিগন্যালের অপেক্ষায় পাশে এসে দাঁড়িয়ে না পড়লে, চোখ চলে যাবে রেলের এলাকা পেরিয়ে দূরের পাঁচ-ছয় তলা বাড়িগুলির দিকে, যাদের বাইরের দেওয়ালে আজও প্লাস্টার পড়ে নি। ইঁট বের করা দেওয়ালের সেই 'ফ্ল্যাটবাড়ির' জানলা জানলায় কটকটে গোলাপি-বেগুনি-কমলা রঙের জামাকাপড় দোলে। ম্রিয়মাণ আবাসনগুলির পেছনে, খানিক দক্ষিণে, মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক রূপালি জ্যামিতিক ধাতব সেতুর ফ্রেম।
ইচ্ছে এবং সুযোগ থাকলে এই সময়ে আপেক্ষিকভাবে সমান্তরাল লাইনগুলির ফাঁকে ফাঁকে গল্প খুঁজে পাওয়া যায়। আমি দুচোখ ভরে শুষে নেওয়ার চেষ্টা করি, যা যা দেখি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাইনের মাঝে একটু ফাঁকা জমিতে দেখি একটুকরো সাজানো বাগান। রেলকর্মীদের অস্থায়ী তাঁবুর অগোছালো সংসারের কোণে বেড়ে উঠেছে যত্নে লালিত লালচে বেগুনি জোড়া নয়নতারা, হলুদ কলকে, লাল টকটকে লঙ্কা জবা। পাশে ভাঙা টিন কিংবা কংক্রিটের টুকরো স্ল্যাবে বসে গল্পগাছায় কিংবা কাজের কথায় মশগুল মধ্যবয়সী দুই তিন জনা রেলকর্মী। আমার মনে হয়, যদি জিজ্ঞেস করি, আপনাদের বাড়ি কোথায়, নির্ঘাত উত্তর আসবে 'নাঢ়া বইহার'। কেন এমন মনে হয় জানিনা। হয়ত অবচেতনে জানি, চতুর্দিকের মগ্ন যান্ত্রিকতার মধ্যে , অস্থায়ী গেরস্থালির ফাঁকে এমন বাগান সাজানোর কথা ভাবেন যাঁরা, তাঁদের আসলে আরণ্যক পড়ার দরকার নেই। তাঁদের মনে অরণ্য বসবাস করে, তাঁদের সাকিন নাঢ়া বইহার না হয়ে যায়ই না।
সার দিয়ে পরপর সাজিয়ে রাখা রেল দিয়ে তৈরি হয়েছে এক ধাতব বেদী,তার ওপরে দিন-দুপুরে, বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে ঘুমিয়ে আছে ময়লা কাপড় পরা এক যুবক। তার দিকে পেছন ফিরে, বেশ কিছুটা দূরে বসে যে নারী, তার মুখের বলিরেখা,দেহভঙ্গী ও সামান্য পোষাক জানায় তার জীবনের অভিজ্ঞতার ভান্ডার বিচিত্র হলেও, আলোকময় নয়। সে সম্ভবত মানসিকভাবে খুব স্থিতও নয়। দুনিয়ার যাবতীয় রেলস্টেশনে, নাগরিক ফুটপাথে কিংবা উদবাস্তু ক্যাম্পে এমন অসংখ্যা নারীর বসবাস। দুই জনকে পাশাপাশি দেখে আমার সেই গল্পটা মনে পড়ে যায়। সম্ভবত প্রতিভা বসুর লেখা, নাম ভুলে গেছি। সেই যে রেল স্টেশনে এক পাগলিনী, আর এক সদ্যযুবক- দুজনেই সেখানে থাকে, দুজনেরই একে অপরকে খুব চেনা লাগে, কিন্তু মা আর সন্তান নিজেদের চিনে নিতে পারে না...সেই গল্পের শেষটা আমি ভুলে গেছি। এদের দুইজনকে দেখে আমার মনে হল- এরাও কি সেইরকম স্মৃতিবিভ্রান্ত ? পাশাপাশি থেকেও ভুলে গেছে কিংবা চেনে না একে-অপরকে?
মনে পড়ে গেল ট্রেন ধরার সময়ে মানকুন্ডু স্টেশনের বেঞ্চে  অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা ছেলেটিকে। আহা, বড় মায়াময়, চিকণ, শ্যামল রূপ তার। পরনে বড্ড বেশি ময়লা প্যাণ্ট, নিচের ঠোঁটের কাছে কেটে রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। থুতনিতে অল্প দাড়ি। কোনোও এক সমান্তরাল সময়কালে , তাকে নাইয়ে ধুইয়ে পাঞ্জাবি -জিন্স আর স্লিং ব্যাগ দিয়ে দিলে সে দিব্যি  দরজার ধারে দাঁড়িয়ে হাওয়া খেতে খেতে প্রাণের বন্ধুর সঙ্গে মোবাইল ফোনে ডিমনিটাইজেশন থেকে শুরু করে, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়ে জলসংকট নিয়ে আলোচনা করতে করতে রাতের শেষ লোকালে বাড়ি ফিরতে পারে।
তিনদিনের ছোট্ট ছুটিতে যাওয়ার পথে, হাওড়া থেকে দুপুরবেলা ফাঁকা ট্রেনে উঠে জানলার ধারে বসে অনেক , অনেকদিন পরে আমরা ঝালমুড়ি কিনে খেয়েছিলাম। খুব যে খিদে ছিল তা নয়,  ওই মুড়ির সঙ্গে যে কাগজের কাছাকাছি পাতলা করে কেটে একফালি নারকেল দেয়, শুধুমাত্র সেটার লোভেই খেলাম।  একমুঠো মুড়ির সঙ্গে একটুখানি নারকেল কুচ করে চিবিয়ে নিতে হবে। মুড়িমাখা যেমনই হোক, ঠোঙার সমস্ত মুড়ি শেষ হয়ে যাওয়ার সময়েও যদি খানিকটা নারকেল তোমার দুই আঙুলের ফাঁকে থেকে যায়, তাহলে বোঝা যাবে তুমি শিখে গেছ কীভাবে প্রতুল আর  অপ্রতুলের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য রেখে জীবনের ছোট্ট ছোট্ট আনন্দগুলো উপভোগ করতে হয়। না, ছোটবেলা থেকে একাধিকবার বিভিন্ন রেলযাত্রায় এই অনুশীলন করার সময়ে এমন তত্ব মাথায় রেখে নারকেলের টুকরো বাঁচিয়ে রাখা অভ্যাস করিনি। প্রতিবার বাঁচিয়ে রাখতে পারিও না। কিন্তু ট্রেনে উঠে ঝিঝিক ঝিঝিক তালের সঙ্গে দুলতে দুলতে মুড়ি আর নারকেলের ব্যালান্স করার চেষ্টাটুকুও না করতে পারলে, সেই যাত্রা দীর্ঘ হোক বা স্বল্প,  অসম্পূর্ণ মনে হয়।