আমরা যখন বেশ ছোট, তখন প্রতি পুজোয় বাবার কর্মস্থল রূপনারায়ণপুর থেকে চলে যেতাম মানকুন্ডু- সেখানে থাকতেন আমার দাদু-ঠাকুমা, কাকারা;আরো কিছু আত্মীয়স্বজন ও বাস করতেন সেই বাড়িতে; পুজোর সময় পিসি-পিসেমশাইরাও আসতেন । কৃষ্ণপট্টি শেঠ লেনের সেই পুরনো বাড়িটা পুজোর কদিন বেশ জমজমাট থাকত। পাঁচ দিনের খাওয়া দাওয়া আলাদা করে বিশেষ কিছু মনে নেই। তবে অষ্টমীর দিন দুপুরে মাংস খাওয়া হত। আর দশমীর দিন সন্ধ্যাবেলা আমাদের বাড়িতে খুব সুন্দর করে বিজয়া সম্মেলন করা হত।  আমার দাদুর এই বিষয়ে খুব উৎসাহ ছিল। সন্ধ্যাবেলা ঠাকুর ভাসান হয়ে গেলে ঠাকুমা সবাইকে শান্তির জল দিতেন। তার আগে কাউকে "শুভ বিজয়া" বলা মানা। (এখনকার মত  নবমী রাত্তির থেকেই মেসেজ পাঠানোর ধূম ছিল না তো!) তার পরে প্রথমে গৃহদেবতা, তারপরে পরলোকগত গুরুজনদের ছবির সামনে মাথা নুইয়ে, তারপরে গুরুজনদের সবাইকে প্রণাম করতে হবে। বাড়ির ছেলেরা করবেন কোলাকুলি, এয়োস্ত্রীরা একে অপরকে সিঁদুর পরাবেন। আমাদের ছোটদের ছিল সব থেকে বেশি মজা। হুড়োহুড়ি করে সবাইকে প্রণাম করা, করতে গিয়ে মাথা ঠোকাঠুকি...।পাড়ার বেশ কিছু মানুষ যোগ দিতেন আমাদের বাড়ির এই অনুষ্ঠানে। প্রণামপর্ব সারা হলে হত ঘরোয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছোটরা যে যার ইচ্ছামত গান -নাচ, আবৃত্তি , এইসব করত, পুরনো দিনের গল্প হত। এসবের সাথে সাথেই আসত মিষ্টি, সাথে নিমকি, বোঁদে, নাড়ু, গজা ইত্যাদি। আর রাতের খাওয়া হত লুচি আর লাবড়া, এবং আরো মিষ্টি।


 
গত তিন দশকে জীবন ও জীবিকার তাড়নায় স্থান-কাল-পাত্রপাত্রী নিয়মিত বদলে গেলেও, বিজয়া দশমী পালনের এই প্রথা আমাদের পরিবারে আমার বাবা-মা টিকিয়ে রেখেছিলেন বছর পাঁচেক আগে অবধিও। দশমীর শেষ বিকেলে  পাহাড় প্রমাণ লুচি বানাতে আমার মায়ের সাথে বিভিন্ন সময়ে হাত মিলিয়েছেন আমার পিসিরা, কাকিমা, এবং এক সময়ে বেশ কয়েক বছর আমিও। আপাতত প্রেসার-কোলেস্টেরল ইত্যাদির ভয়ে কেউই আর লুচি খাওয়ার উৎসাহ বিশেষ রাখি না বলে সেই অভ্যাস বন্ধ হয়েছে।  সময়ের সাথে সাথে  আত্মীয়স্বজনদের সাথে যোগাযোগও হয়েছে ক্ষীণ, ইদানীং এমনিতেও অত লুচি ভাজার দরকার পড়ে না।

পুজোর খাওয়াদাওয়ার কথা হবে, অথচ বাইরের হাবিজাবি খাওয়ার গল্প হবে না, তা তো আর হয় না ! আমাদের বাড়িতে বাইরের তেলেভাজা খাওয়ার ব্যাপারে বাবার ঘোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। আমার রাঙাকাকু একবার পুজোর সময়ে বাড়ির সবাইকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে, কোল্ড ড্রিঙ্কস-এর বদলে সবাইকে মিল্কোস খেতে বাধ্য করেছিলেন। আমরা একটু বড় হওয়ার পরে অবশ্য বাবা-কাকার এই অমানবিক শাসন থেকে আমাদের রক্ষা করেন পিসেমশাইরা এবং রাঙাকাকিমা। এঁদের সাথেই প্রথম ফুচকা, চপ, এগ রোল ইত্যাদি নিষিদ্ধ বস্তু পুজোর সময়ে খাওয়ার ছাড়পত্র পেয়েছিলাম। বাবা আদপে খুব রেগে গেলেও জামাইদের আর বউমাকে আর শাসন করেন কিভাবে?

পুজোর সময়ে হাবিজাবি খাওয়ার জন্য হাতখরচার টাকাও পেতাম অন্যান্য গুরুজনদের কাছ থেকেই। আমি সবার বড় বলে সবার থেকে একটু বেশি পেতাম। সেটাকে খরচা করতাম ভাইবোনেদের জন্য ওইসব 'অখাদ্য-কুখাদ্য'  কিনে - বাদামভাজা, ঝালমুড়ি, লজেন্স । সেই টাকায় কিনে খাওয়া তেল চুপচুপে আলুর চপ বা  সদ্য পরিচিত এগ রোল তখন মনে হত রাজকীয় খাদ্য ! এর কিছুদিন পরে, আমাদের ছাপোষা মফস্বলী খাদ্যরসিকদের জীবনে  আলোড়ন তুলে আবির্ভূত হল নতুন খাবার- চানা-বাটোরা।  অবশ্যই বাবার ভয়ে সেই মহার্ঘ খাদ্য কিনে খেয়ে দেখার উপায় নেই। শুধু দেখছি বাজারের নতুন রেস্তোঁরাতে লোকজন গান্ডেপিন্ডে চানা বাটোরা খাচ্ছে। পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে গন্ধে মন উচাটন। অগত্যা অপেক্ষা পুজোর জন্য।  বাড়ির সবাইকে না জানিয়ে অষ্টমীর সন্ধ্যাবেলা আমরা মামাতো-পিসতুতো ছয় ভাই-বোন চলে গেছিলাম আমলাদহি বাজারে লুকিয়ে চানা বাটোরা খেতে। সেই অভিযানে অবশ্যই আমিই নেতা। বাড়িতে বলে বেরিয়েছি অন্য পাড়ায় যাচ্ছি ঠাকুর দেখতে। কিন্তু রক্ষে আছে কি? পড়বি তো পড় মালীর ঘাড়ে-- রাস্তায় দেখা রাঙাকাকুর সাথে। তিনি সবে সপরিবারে ট্রেন থেকে নেমে বাড়ি ঢুকছেন। আলো আঁধারি রাস্তাতে ঠিক চিনে ফেলেছেন আমাদের-
এই তোরা সবকটাতে মিলে কোথায় যাচ্ছিস? - চলমান রিকশা থেকে সজোরে হাঁক।
-আরে তোমরা এসে গেছ, যাও যাও বাড়ি যাও, আমরা এই ঠাকুর দেখেই আসছি...
তারপরে আর কি? দোকানে গিয়ে, অর্ডার দিয়ে চানা বাটোরা খেলাম ঠিকই, কিন্তু মনে মনে এন্তার ভয়, বাড়িতে ঠিক ধরে ফেলবে, আমরা চানা বাটোরা খেতে এসেছিলাম। ধরে ফেলেওছিলেন সবাই, কিন্তু পুজোর সময় বলে, বিশেষ বকাবকি কেউ করেন নি।

আমাদের ছোটবেলায় পাড়া প্রতিবেশিদের বাড়িতে বিজয়ার প্রণাম সারতে যাওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল। বেশিরভাগ বাড়িতেই বরাদ্দ থাকত নাড়ু, নিমকি, গজা, সাথে মিষ্টি আর ঘুঘনি।
আমার বাবার কাছে ছাত্র-ছাত্রীরা টিউশন পড়তে আসত। তাদের জন্যেও বরাদ্দ থাকত মিষ্টি। তাদের মিষ্টির সাথে দেওয়ার জন্য বেশি করে ময়রার কাছ থেকে এনে রাখা থাকত শুকনো বোঁদে, গজা আর কুচো নিমকি। তবে সেগুলি বেশিরভাগ অবশ্য আমার পেটেই যেত।

পুজোর খাওয়াদাওয়ার কথা বলতে গেলে লক্ষ্মী পুজোকে বাদ দেওয়া চলে না। বিজয়ার রেশ কাটতে না কাটতেই এসে পড়ে লক্ষ্মীপুজো। আমরা আদতে ওপার বাংলার মানুষ বলে আমাদের বাড়িতে কোজাগরী পূর্ণিমাতে লক্ষ্মীপুজো হয়। খিচুড়ি, লুচি, পাঁচ রকমের ভাজা, লাবড়া, ফুলকপির তরকারি, চাটনি, পায়েস - আগের দিন সকাল থেকে আমার মা নিরন্তর এই আয়োজনে ব্যস্ত থাকতেন। সাথে বানানো হত নারকেল নাড়ু। এই রান্না করা ভোগের সাথেই মা লক্ষ্মীর প্রসাদ হত নারকেলের জল, কাঁচা ফল, নারকেল কুচি, কাঁচা চিঁড়ে, খই, মুড়কি, কদ্‌মা, বাতাসা, নকুলদানা, নাড়ু, সন্দেশ, চাল-কলা মাখা আর তালের ফোঁপোড়। এই শেষোক্ত বস্তুটি বেশ কষ্টকরে পেতে হয়। ভাদ্র মাসে তালের ক্ষীর, বড়া ইত্যাদি বানানোর পরে তালের বীজ/ আঁটি গুলিকে মাটির নিচে পুঁতে দিতে হয়। লক্ষ্মীপুজোর সময়ে মাটি খুঁড়ে সেগুলি বার করে ভাঙলে দেখা যায়, ভেতরে সাদা মোটা শাঁস তৈরি হয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা থার্মোকলের মত দেখতে, খুব হালকা একটা মিঠে স্বাদ। মা লক্ষ্মীর এই অদ্ভূত জিনিষটি কেন পছন্দ সেটা বলা খুব মুশকিল অবশ্য।কিন্তু  এটা আমাদের ভাইবোনেদের খুব পছন্দের খাদ্য ছিল, এবং মাঝেমধ্যে কে বেশি টুকরো পাবে তাই নিয়ে হাল্কা ঝগড়াঝাঁটিও হয়ে যেত।

বাবা-মায়ের সাথে কলকেতা শহরে এসে ইস্তক অবশ্য মা লক্ষ্মীর কপালে আর ফোঁপড় জোটেনি। নিয়ম করে অষ্টমীর মাংস বা দশমীর লুচি-লাবড়ার পাট মোটামুটি উঠে গেছে।বিজয়ার প্রণাম সারতে কোথাও গেলেও প্লেটে থেকে মিষ্টান্নসমূহকে যতটা সম্ভব বিদায় করি। আর তখন মনে পড়ে, এক সময়ে পুজোর প্রসাদে কদ্‌মা আর রঙিন মঠ বেশি করে ভাগে পাওয়ার জন্য কি কান্ডই না করতাম!

 

ছবিঃ উইকিপিডিয়া