গতকাল , ২৪শে এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যাবেলায় সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত সুথল পথিকৃৎ সম্মান ২০১৫ এর অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ হয়েছিল। বোরোলিন, সুথল এবং আরো অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী প্রস্তুতকারি সংস্থা জি ডি ফার্মাসিউটিক্যাল্‌স্‌ এর এই উদ্যোগের পিছনে উদ্দেশ্য- আমাদের এই আপাত বিপর্যস্ত সমাজের  মধ্যে থেকেই যে সব মানুষ সবার চোখের আড়ালে, মানুষের সার্বিক উন্নতির পথে নিরলস কাজ করে চলেছেন, তাঁদের সম্মানিত করা, এবং পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসা-আরো একবার। গতকালের অনুষ্ঠানে সম্মানিত করা হল তিনজন এমনই মানুষকে - ডঃ অপূর্ব ঘোষ, দরিদ্র, অভাবি শিশুদের  কম খরচে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যিনি গত কয়েক দশক ধরে কাজ করে চলেছেন কলকাতার ইন্সটিটিউট অফ চাইল্ড কেয়ার-এ; ডঃ প্রশান্ত ব্যানার্জি, যিনি বিজ্ঞানসম্মত প্রথায় হোমিওপ্যাথি ওষুধের প্রয়োগে সারিয়ে তুলছেন ক্যান্সারের মত মারণ ব্যাধি এবং তৈরি করেছেন হোমিওপ্যাথি ওষুধ প্রয়োগের বিজ্ঞানসম্মত নিয়মাবলী, এবং নৃত্যগুরু শ্রীমতী অলকানন্দা রায়, যিনি পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন সংশোধনাগারের অধিবাসীদের নৃত্যগীত চর্চার মাধ্যমে সুস্থ, সৃষ্টিশীল জীবনের দিকে এগিয়ে চলার পথ দেখাচ্ছেন। প্রথম দুজন মানুষের জীবন বাঁচিয়ে তোলেন, তৃতীয় পথিকৃৎ মানুষটি দুঃখী মানুষদের মনকে বাঁচিয়ে তুলছেন।


এঁদের কাজকর্ম, অনুষ্ঠান বিষয়ে উদ্যোক্তাদের লক্ষ্য এবং এই অনুষ্ঠানের জন্যই বিশেষ ভাবে তৈরি থিম সংটি বিষয়ে জানতে পারবেন বোরোলিনের ওয়েবসাইটে গিয়ে- এই লিঙ্কে


অনুষ্ঠানের সঞ্চালনায় ছিলেন মীর। উপস্থিত ছিলেন 'এলিন' ব্র্যান্ড এর মুখ শুভশ্রী। থিম সংগীতের লেখক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, সুরকার জয় সরকার, সাথে লোপামুদ্রা মিত্র, যিনি গানটি গেয়েছেন।  অনুষ্ঠানের প্রথমার্ধে পুরষ্কার প্রদানের পরে, দ্বিতীয়ার্ধে প্রথমে সঙ্গীত পরিবেশন করেন লোপামুদ্রা মিত্র, তারপরে ছিল শ্রীমতী অলকানন্দা রায়ের নির্দেশনায় পশ্চিমবঙ্গের এক/একাধিক ( এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই) সংশোধনাগারের বাসিন্দাদের নিয়ে নৃত্যানুষ্ঠান -' ধ্রুবজ্যোতি তুমি যীশু'।

কাজের সূত্রে এই অনুষ্ঠানে যাওয়ার আমন্ত্রণ পাই। সত্যি বলতে কি, এই শেষের অনুষ্ঠানটা দেখার জন্যই আসলে গিয়েছিলাম, কারণ জানি, এরকম সুযোগ বার বার আসে না। 'মুক্তধারা' দেখার পর থেকেই মনে মনে ভেবে রেখেছি, সুযোগ পেলে একবার দেখব সত্যি সত্যি কিরকম ভাবে হয় জেলের বাসিন্দাদের নিয়ে এই অনুষ্ঠান !- জেলই লিখলাম, কারণ সংশোধনাগার শব্দটা আমরা কজনই বা ব্যবহার করি? দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছি। রবীন্দ্রনাথের গানের সাজানো প্রায় ৫৫ মিনিটের এই নৃত্যনাট্যে তুলে ধরা হয়েছে যীশু জন্ম থেকে শুরু করে ক্রুশবিদ্ধ হওয়া এবং পুনরুত্থান অবধি ঘটনাবলী। যেমন যথোপযুক্ত ছিল সঙ্গীতের ব্যবহার , তেমনই সুন্দর ছিল মঞ্চসজ্জা, পোষাক পরিকল্পনা, আলোকসজ্জা - সব কিছু। পুরোপুরি পেশাদারি দলের অনুষ্ঠানের সঙ্গে কোনই তফাত নেই। প্রায় ৫০ জন্য বিভিন্ন বয়সী শিশু, মহিলা এবং পুরুষ অংশ নিয়েছিলেন এই নৃত্যনাট্যে। সাথে অবশ্যই ছিলেন অলকানন্দা রায় নিজে। সব থেকে ভাল লাগল, যখন অনুষ্ঠানের শেষে অলকানন্দা এসে প্রত্যেকের নাম আলাদা আলাদা করে ঘোষণা করলেন। বললেন, কোন মানুষই খারাপ হয়ে জন্মায় না, তার পরিস্থিতি তাকে খারাপ করে তোলে। মা হয়ে তাঁর ছেলেমেয়েদের জন্য উপস্থিত সবার কাছ থেকে চেয়ে নিলেন আশীর্বাদ।

তবে অনুষ্ঠানের শেষে এই পুরো উপস্থাপনার একটা standing ovation প্রাপ্য ছিল। সেটা হল না। আমরা কয়েকজন ইতস্তত উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছিলাম বলে পেছন থেকে শুনতে হল 'এবার বসে পড়ুন' ! কি আর করা যাবে, টিকিট কেটে তো অনুষ্ঠান দেখতে যেতে হয়নি, সবাই আমন্ত্রিত। আমরা আমন্ত্রিত হয়ে তোমাদের অনুষ্ঠান দেখতে এসেছি, তাতে তোমরাই ধন্য হও। আমরা বসেই থাকি আরামের আসনে।

এই অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে আরো একটা উপলব্ধি হল। আমরা যারা একটু বেশি বই-টই পড়ে ফেলেছি, সব বিষয়কেই কাটাছেঁড়া করতে উৎসাহী ( অবশ্যই সদর্থে ), তারা তো সব কিছুকেই প্রশ্ন করি, লজিক খুঁজি, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ চাই, ঐতিহাসিক প্রমাণ চাই...এক কথায় মাথার ভেতরে বেশ বড়ই জিলিপির প্যাঁচ! এই নৃত্যনাট্য দেখতে দেখতেই আমার প্যাঁচালো মাথাও ভাবতে থাকল- যীশু আর কোথায় সত্যি সত্যি ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন? এই তো সেদিন এক উপন্যাস পড়লাম, যেখানে যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়া এবং পুনরুত্থানকে কিভাবে দারুণ চুরচেরা বিশ্লেষণের সাথে রহস্য রোমাঞ্চ মিশিয়ে বলা হয়েছে  যে ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পরে যীশুকে কিভাবে রক্ষা করা হবে, সেটা পুরোটাই আগে থেকে যীশুর পরিবার এবং সঙ্গীরা পরিকল্পণা করে রেখেছিলেন, পুনরুত্থান আসলে হল যীশুর ক্ষতগুলিকে সারিয়ে তোলার পরবর্তী পর্ব, শেষ জীবনে তিনি ভারতের কাশ্মীর উপত্যকায় এসে বসবাস করতেন...তারও আগে এক সাড়া জাগানো আন্তর্জাতিক উপন্যাসে লেখক দেখিয়েছিলেন কিভাবে যীশুর বংশধরদের খোঁজ পাওয়া গেল...কেউ কেউ বলেন যীশুর ধারণাটা পুরোপুরিই বানানো, ওইরকম কেউ ছিলেনই না...ইত্যাদি ইত্যাদি গরমগরম আলোচনায় চায়ের কাপে তুফান আমরা তুলেই থাকি, তাই আজকের এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে দাঁড়িয়ে যীশুখ্রীষ্টের জীবন নিয়ে হওয়া নৃত্যনাট্য দেখে আমার কি এতটা পরিতৃপ্ত হওয়া উচিত...

কিন্তু তার পরেই  ভাবলাম, এই অনুষ্ঠানের শুরুতে ঘোষক জানাচ্ছিলেন কিভাবে এই নৃত্যনাট্য করার সময়ে অংশগ্রহণকারীদের মানসিক পরিবর্তন হয়েছে। যীশুখ্রীষ্টের জীবনের গল্প, যার বেশিরভাগটা জুড়েই রয়েছে ভালবাসা, সহমর্মিতা, সহনশীলতার কথা, স্পর্শের দ্বারা অন্ধকে দৃষ্টিদান বা মৃতকে বাঁচিয়ে তোলার মত অবৈজ্ঞানিক বা আজগুবি গল্প, একজন ভাল মানুষের গল্প, যিনি মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্যেও ছিলেন পরম ক্ষমাশীল - এহেন আপাত সরলরৈখিক একটা গল্প যদি যুগ যুগান্তর ধরে মানবসমাজের একটা বড় অংশকে, যারা বিশেষ বই-টই পড়েনি/পড়েনা/ পড়ার সুযোগ পায়না - তাদেরকে- সদিচ্ছার প্রতি, শুভবুদ্ধির প্রতি, ভালোর প্রতি  আগ্রহী করে তোলে, তাতে ক্ষতি কি?  আর এই কথাটা সভ্যতার আদিযুগ থেকেই মানুষ বুঝতে পেরে  এসেছে বলেই বোধহয়, সারা পৃথিবী জুড়েই যেকোন ধরণের পুরা্‌ লোককথা  এবং 'মিথ' এর কদর আজও কমেনি।

শুধু কেউ কেউ আবার নিজেদের প্যাঁচালো মাথাগুলিকে একটু বেশি খাটিয়ে সেইসব প্রাচীন  সরলরৈখিক কাহিনীগুলির খোলনলচে পালটে নিজেদের সুবিধার্থে ব্যবহার করছে, এটাই সমস্যা !

(আমার মোবাইল ক্যামেরাটি অতীব দুর্বল, তাই ছবি তুলতে চাইলেও সেগুলি খুব কাজের হয়নি। তাও সাথে দিলাম দুই- একটা। )